বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর তারিখ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষকদের অবদান স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০ টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে । এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ই আই প্রতিবছর এটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে রাখে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে ২০১৮ সালে ইউনেস্কো ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষার অধিকার মানে হচ্ছে, ‘যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক পাওয়ার অধিকার’। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সব মানুষকে এই বলা হচ্ছে যে, শিক্ষার অধিকার প্রশিক্ষিত ও যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার অধিকার ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। এই সংস্থার মতে বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ২৭ কোটি বা তারও বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষা হতে বঞ্চিত। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছতে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাতকোটি নতুন শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন। মেয়েশিশু, প্রতিবন্ধী, শরণার্থী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত অনেক বেশি ।এই ব্যবধান দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন “যাঁরা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অভিভাবকদের থেকে অধিক সম্মানীয়। পিতামাতা জীবন দান করেন ঠিকই, শিক্ষকেরা সেই জীবনকে গড়ে তুলতে সহায়তা করেন।”
একজন ছাত্রছাত্রীর জীবনে যোগ্য শিক্ষকের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ শিক্ষকই পারেন তার শিক্ষার্থীকে নিশ্চিতরূপে আদর্শগতভাবে রূপান্তর করতে। আগামী জীবন যাত্রায় প্রতিটি উপযুক্ত জীবিকা ও সৎনাগরিক তথা মানুষ গড়ার কারিগর তারাই। তাই পন্ডিত জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন -He has served his nation in many capacities, but above all of us have learnt much and will continue to learn.
দিনকাল বদলেছে, সেইসাথে বদলে গেছে শিক্ষকদের মানসিকতা। কিছু কিছু শিক্ষকের গাফিলতি, হীনম্মন্যতা, বিকৃতরুচির কারণে শিক্ষকতা পেশাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে আজ শিক্ষক সমাজের শুভদিনে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত প্রত্যেকের অঙ্গীকার – নিজেকে প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার ।
এবার আসি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাপনার কথা। এই দেশের অধিকাংশই শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক। তাই সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের সন্তানদের লেখাপড়ার গুরুদায়িত্ব এই বেসরকারি শিক্ষক সমাজ বহন করে থাকেন। সমাজে এরাই অবহেলিত। তাই একজন শিক্ষককে যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠতেই তার সামাজিক মর্যাদার সাথে সাথে আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই জরুরি। একজন শিক্ষক যদি শিক্ষাদান করতে গিয়ে পারিবারিক অভাব অনটনের কথা চিন্তা করতে হয়, তখন তার পাঠদান স্বাভাবিক কারণে বিঘ্নিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে দেরীতে হলেও কিছুটা এগিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। এম.পি.ও ভুক্ত শিক্ষকদের মূলবেতনের ২৫% বাৎসরিক দুবার, কর্মচারীদের ৫০% বাৎসরিক দুবার উৎসব ভাতা ও ৫% প্রবৃদ্ধি চালু করেছেন। এজন্য সরকার প্রশংসার দাবী রাখেন।
বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ঘোষণায় শিক্ষার গণমুখী বিকাশকল্পে সুদীর্ঘকালের জাতীয় প্রত্যাশা পূরণের দ্বার উন্মুক্ত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জাতীয় শিক্ষানীতির কার্যকর বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আশার খবর হচ্ছে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে NTRCA কর্তৃপক্ষ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ২২ হাজার সহকারী শিক্ষক নিয়োগ করছেন। গত ৩১/০৮/২০২০ তারিখে NTRCA চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন এক ঘোষণায় বলেছেন। এটি আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে সম্পন্ন করবেন বলে তিনি নিশ্চায়ন করেছেন। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণকল্পে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিপ্রেত বৈষম্যের অবসান করে সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের অনুরূপ ৪০-৫০% বাড়িভাড়া, সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর অনুরূপ মেডিকেল ভাতা,বছরে দুটি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদান করা না গেলে এ পেশায় যোগ্য ও মেধাবীরা এগিয়ে আসবেন না। আর শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতির মিশন মুখ থুবড়ে পড়বে। সরকার ঘোষিত দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ভিশন ২০২১ এবং রূপকল্প -২০৪১ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন জরুরি বলে শিক্ষা সম্পর্কীত অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
লেখক : শিক্ষক