বিশ্বে চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। প্রতি ইঞ্চি জমিনে মানবাধিকার হরণের করুণ আহাজারি শুনা যায়। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মানবাধিকারের আড়ালে অসহায় নির্যাতিত মানবতার উপর জুলুমের ষ্টিম রোলার চালাচ্ছে। চারদিকে শুধু শুনা যায় মানবতার কান্না আর কান্না। মানবাধিকারের ডংকা বাজিয়ে মানবতা বিরোধী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে পশ্চিমা বিশ্ব। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গাজা। গাজার মানুষেরা জীবনের নিরাপত্তা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বারবার। গাজার প্রতিটি বালুকারাশিতে অসহায় ও নির্যাতিত মানবতার রক্ত এখনো লেগে আছে। গাজার প্রতিটি ইট–শুড়কির ভেতর শুনা যায় অত্যাচারিত মানুষের আহাজারি আর কান্না। নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে পাষন্ড ইসরায়েল। পৃথিবীর একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রটিকে লাগাম টেনে ধরার মতন যেন কেউ নেই। বিশ্ব মোড়ল খ্যাত ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর প্রত্যেক্ষ মদদে গাজায় দীর্ঘ ২ বছর ধরে পাখির মতন গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ গাজাবাসীদের। এক কোটি ইহুদী সারা বিশ্বের ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রের জনগণকে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে। পৃথিবীর একমাত্র উপত্যকা-‘গাজা’ যেখানে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল হয় সমানতালে। পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারের বুলি আউরালেও বস্তুত তারা মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্য কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, শোষিত ও মজলুম জনতার কন্ঠস্বর, সাইয়্যেদেনা মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আ’লামিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানবাধিকারের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন ১৫০০ বছর আগে। বিশ্ব মানবাধিকারের মূল প্রবক্তা রাসূল (সাঃ)-এটা বিশ্বাস না করার মতন কোন সুযোগ নেই। সেজন্যে বিধর্মী দার্শনিক মাইকেল এইচ হার্ট তার অনন্য গ্রন্থ দ্যা হান্ড্রেডস বইটিতে আমাদের রাসূল (সাঃ) এর বিদায় হজ্বের ভাষণে প্রদত্ত মানবাধিকার বিষয়ক অসাধারণ ঘোষণার জন্য সারা বিশ্বে ১০০ জন মনীষীর মধ্যে তাঁর নাম সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। পশ্চিমারা মনে করে, জাতিসংঘ সনদ, ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা, ইরষষ ড়ভ জরমযঃং ইত্যাদি মানবাধিকার রক্ষার মূল হাতিয়ার। ১৫০০ বছর আগে মক্কার আরাফাত ময়দানে প্রদত্ত বিশ্বনবী বিদায়ী হজ্বের ভাষণে যে মানবতার কথা বলে গেছেন তার ছিটেফোঁটাও উপরোল্লেখিত সনদের ভেতর নেই। বিদায়ী হজ্বের ভাষণের মধ্যে পতিত রয়েছে বিশ্ব মানবাধিকারের মহান বীজ। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব ঘোষণা ইত্যাদি সেই বিদায়ী হজ্বের ভাষণ থেকেই উৎকলিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব আধুনিক মানবাধিকার নীতিতে কোন নতুনত্ব যোগ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিদায়ী হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘আরব অনারব, সাদা–কালোতে কোন ভেদাভেদ নেই। নেই কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য। আরবদের উপর যেমন অনারবদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আবার অনারবদের উপরও আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদমকে মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আনুগত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইসলামের মধ্যে গ্রোথিত রয়েছে। ‘একজন কুৎসিত আবেসনীয় কৃতদাসও যদি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব দখল করে এবং তোমাকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী চালায়, তাহলে তার কথা শুনো এবং মানো’। জীবনে নিরাপত্তা লাভের অধিকার সমুন্নত করেছে ইসলাম। এটাই ইসলামের মানবাধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে বলেছেন, ‘কোন মানুষকে হত্যা করা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্নক কাজ ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে যে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আবার যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিল’– সূরা মায়েদা– ৩২। অন্য একটি আয়াতে আছে, ‘কোন জীবনকে তোমরা হত্যা কর না, যা আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন, তবে বিধি সম্মতভাবে হত্যার কথা আলাদা’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিদায়ী হজ্বের ভাষণে দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘হে লোকসকল, তোমাদের জান, মাল, ইজ্জত, আবরুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম করা হল’। হাদীসে এসেছে, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তি নিহত হওয়ার তুলনায় সমগ্র পৃথিবীর পতন আল্লাহর দৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার’। সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে ইসলাম। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘তোমরা একে অন্যের অর্থ–সম্পদ অবৈধভাবে আত্নসাৎ কর না, জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে অন্য মানুষদের সম্পদের কোন অংশে ভোগ করার জন্য বিচারকদের সামনে ঘুষ হিসেবেও পেশ কর না’–সূরা বাকারা–১৮৮। ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ’– (বুখারী)। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিদায়ী হজ্বের ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের জীবন ও ধন সম্পদ কেয়ামত পর্যন্ত পরস্পর নিকট পবিত্র’ – (বুখারী, মুসলিম)। ধর্মপালন ও বিবেকের অধিকার প্রদান করেছে ইসলাম। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই, সত্য এখানে মিথ্যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে’ সূরা বাকারা–২৫৬। ‘তুমি কি মানুষদের উপর জোর জবরদস্তি করবে যেন তারা সবাই মোমেন হয়ে যায়’–সূরা ইউনূস– ৯৯। মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার সু–নিশ্চিত করেছে ইসলাম। আর এটাই হচ্ছে ইসলামে মানবাধিকারের সুন্দর দৃষ্টান্ত। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘তাদের ধন সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত লোকদের অধিকার রয়েছে– সূরা যারিয়াত–১৯। বাক স্বাধীনতার অধিকার সু–নিশ্চিত করেছে ইসলাম। মানুষের চিন্তা,চেতনা, বিশ্বাস ও তার মত প্রকাশের অধিকারকে ইসলাম যতই না গুরুত্ব দিয়েছে–যা অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে দেখা যায় না। মানুষের বক্তব্য, তার চিন্তা–বিশ্বাসকে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর একটি হাদীসে বর্ণিত–তিনি বলেন, ‘আমার পরে কতিপয় স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে, যারা তাদের মিথ্যাচারে সহযোগিতা করবে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারে মদদ জোগাবে, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমি তাদের নই’-(নাসাঈ)। খলিফা হযরত আবু বক্কর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ) তাদের কৃত ভুলসমূহের সমালোচনা করার জন্য জনগণকে আহবান করতেন এবং জনসাধারণও নির্দ্বিধায় শাসকদের সমালোচনা করতেন। বন্দীদের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন ইসলাম। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে যেন আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করি’। ইজ্জত ও সম্মান লাভের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে ইসলাম। বিদায়ী হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জান মালের নিরাপত্তার সাথে সাথে ইজ্জত আবরুর মর্যাদা রক্ষারও নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘হে মুমিনগণ তোমরা বেশি বেশি অনুমান করা থেকে বেঁচে থাক। কিছু কিছু অনুমান অপরাধ এবং একে অপরের পেছনে গোয়েন্দাগিরি কর না, একজন আরেকজনের গীবত কর না’–সূরা হুজুরাত–১২। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যে কত সুদৃঢ় হতে পারে তা ইসলাম ১৫০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে। মানবাধিকারের পূর্ণ সমাধানের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন বিশ্ব মানবতার রাসূল (সাঃ) তাঁর বিদায়ী হজ্বের ভাষণের মাধ্যমেই। আসুন, আল্লাহর কোরআন ও রাসূল (সাঃ) এর হাদীসের আলোকে আল্লাহর এই জমিনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার মেহনত করি। আমিন।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল