বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস

মো. আনোয়ার কবির | শুক্রবার , ২৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলায় একটা সাধারণ কথা প্রচলিত আছে পানির মত সহজ। এটা কীভাবে আসলো জানি না। তবে পানি কিন্তু এত সহজ বিষয় না। মাত্র দুই মিনিটে পানির দুই ইঞ্চি নিচে একজন মানুষ ডুবে মারা যেতে পারে। বিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ জনেরও বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে যে কারো মত্যু হতে পারে তবে শিশু ও তরুণদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়ে থাকে। পানিতে ডুবে মৃত্যু শিশু মৃত্যুর একটা বড় কারণ। বয়স ১ থেকে ২৪ বয়সীদের মৃত্যুর ১০ টি প্রধান কারণের মধ্যে ডুবে যাওয়া অন্যতম। এক হিসাব মতে সারা পৃথিবীতে ২০২১ সালে তিন লক্ষেরও অধিক মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটে। পানিতে ডুবে মৃত্যুহার স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বেশি। এসকল দেশে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় তিন গুণবেশি মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।

জাতিসংঘ ২০২১ সালে ২৫ শে জুলাইকে বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে। পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ন্ত্রনণ করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর সুপারিশকৃত বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন ধাপে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো সম্মত হয়ে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার অংগীকার করেছে।

১) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য সূচীতে সাঁতার ও পানিতে সুরক্ষার দক্ষতা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ফলে অনেক তরুণ পানিতে নিরাপদ সুরক্ষার জন্য নিজেকে তৈরী করতে পারে। ২) দেশে সুইমিং পুলের চারপাশে নিরাপদ বেস্টনি দেওয়ার আইন। ৩) নৌকা চালনার সময় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহারের জন্য জাতীয় আইন। লাইফ জ্যকেট জরুরি পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং জীবন বাঁচাতে পারে। ৪) দেশে দুর্যোগপূর্ণ ও জরুরি অবস্থায় জাতীয় অনুসন্ধান এবং উদ্বার পরিসেবা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা। জাতীয় আবহাওয়া সর্তকতা বিনামূল্যে প্রদান, যা চরম আবহাওয়ার সময় নিরাপত্তা তথ্য দেয়।

পানিতে ডুবে যাওয়া বিষয় বিভিন্ন সংস্থা, সমাজ, পরিবার ও তরুণ শিক্ষার্থীরা, আমরা সবাই একসাথে কাজ করলে প্রতিরোধ করতে পারি। একটি প্রাণহানি একটি পরিবারের জন্য অনেক ভয়াবহ। বাংলাদেশে অসংখ্য শিক্ষার্থী, পর্যটক ও নানা বয়সের মানুষ পানিতে ডুবে যায়। অনেক সম্ভবনাময় তরুণের মৃতুর ঘটে। একটা পরিবারের স্বপ্ন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পরিবার, সমাজ ও দেশ হারিয়ে ফেলে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের ভালো জনসম্পদ।

জাতিসংঘ ঘোষিত রেজুলেশন: ৭৫/২৭৩: বিশ্ব ব্যাপী ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ: ২৫ শে জুলাইকে বিশ্ব ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সকল সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিক সংস্থা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সংস্থা, সেইসাথে নাগরিক সমাজ, বেসরকারি খাত, শিক্ষাবিদ এবং ব্যক্তিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের, যথাযথ পদ্ধতিতে এবং জাতীয় দিবস অগ্রাধিকার অনুসারে, শিক্ষা, জ্ঞান বিনিময় এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যাতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধের গুরুত্ব এবং প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু হ্রাস করার লক্ষ্যে পানিতে নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য জরুরি সমন্বিত বহুক্ষেত্রীয় পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।

চট্টগ্রাম বিভাগের ভূ-প্রকৃতি বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে আলাদা। এখানে বৈচিত্র্যময় পাহাড়, ঝর্না, লেক, পাহাড়ী খর স্রোতা নদী, গিরিপথ, বন আর বিশ্বের বৃহৎ সমুদ্র সৈকত রয়েছে। তাই চট্টগ্রাম বিভাগকে বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী বলা যায়। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও মানুষের মননশীলতা বৃদ্ধির সাথে প্রতিবছর পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক তথ্যে দেখা যায় বছরে বাংলাদেশে ডোমেস্টিক পর্যটকের সংখ্যা ০২ কোটি। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু পর্যটকদের জীবন নিরাপত্তার বিরাট অভাব তৈরি হয়েছে। যত্রতত্র স্পট তৈরি হয় সরকার ভালো রাজস্ব পায়, কিন্তু সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে কোন রেলিং ও প্রতিবন্ধকতা থাকে না। জীবন রক্ষার লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোট, জরুরি উদ্বারের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামদি থাকে না, কোন কার্যক্রম ও নাই। স্পটে ঢুকার মুখে নিরাপত্তা তথ্য ও বড় সাইন বোর্ডে জরুরি তথ্য সম্বলিত প্রচারণা নাই। অথচ সরকার রাজস্ব পায়, ইজারাদার, হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টে ওয়ালার ব্যবসা সম্প্রসারণ করে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে সম্ভবনাময় তরুণ পর্যটকের সংখ্যা অসংখ্য। সারা বিশ্বে প্রতিবছর এ সংখ্যা তিন লক্ষের মত। বেশির ভাগ মৃত্যুই দরিদ্র দেশগুলোতে ঘটে। জাতিসংঘ ২০২১ সালে ‘২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর বিশ্বে এই দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশ ও সেই ঘোষণার সাথে একাত্ব হয়ে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু তেমন কার্যক্রম নেই। তাই পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

গত ১৪ই জুন, শনিবার, বিকাল ৪টায়, চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্ট পাবলিক কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী ও ডিওএইচএস অধিবাসী তাসিন আনোয়ার, সীতাকুন্ড লেকে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। ডিওএইচএস লেকে সিইএসসি শিক্ষার্থী শান মৃত্যুবরণ করে। কক্সবাজারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী ছাড়াও সম্প্রতি অনেক মেধাবী ছাত্রের পানি দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

‘ANYONE  CAN DROWN BUT NO ONE SHOULD ’ বয়স, সাঁতারের ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা নির্বিশেষে যে কেউ ডুবে যেতে পারে। এমনকি শক্তিশালী সাঁতারুদেরও, বিভিন্ন জলজ পরিবেশে হঠাৎ অক্ষমতা (যেমন, কোনও চিকিৎসা সমস্যা বা আঘাতের কারণে), তীব্র স্রোত, বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মতো কারণগুলি জন্য ডুবে যেতে পারে। আমেরিকার বিখ্যাত সতারু Fran Crippen পানিতে ডুবে মারা যায়।

পানির কাছাকাছি শিশুদের, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের সক্রিয় এবং সতর্ক তত্ত্বাবধান দরকার। সাঁতার শেখা এবং জল সুরক্ষা দক্ষতা অনুশীলন করা। উপযুক্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, যেমন লাইফ জ্যাকেট, বিশেষ করে নৌকায় বা খোলা পানির সাঁতার কাটার সময়। সিপিআর এবং উদ্ধার দক্ষতা শেখা। পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুরক্ষার শিক্ষা প্রচার করা।

প্রিয় সন্তান ইয়াসির পরিবারের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে সাগরে ডুবে যায়। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কক্সবাজারে পর্যটকদের জরুরি উদ্বারের জন্য ইয়াসির লাইফ গার্ড এই পর্যন্ত ৭৪২ জন মানুষকে সাগরে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। পর্যটন স্পটগুলোতে এই ধরনের কার্যক্রম আরো প্রয়োজন।

সরকার, সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবি, শিক্ষার্থী ও আম জনতা সবাইকে পনিতে নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। লেখক: প্রকৌশলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধজুলাই অভ্যুত্থান : অপ্রতিরোধ্য সাহসে এগিয়ে যায় যৌবন