বিশ্ব খিঁচুনী দিবস : করোনা পরিস্থিতিতে করণীয়

প্রফেসর (ডা:) মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু | সোমবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী,২০২২ আন্তর্জাতিক খিঁচুনী দিবস পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৬৪টি দেশে একসাথে এই খিঁচুনী দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসের ২য় সপ্তাহের সোমবারে এই দিবসটি পালিত হয়। মূলতঃ খিঁচুনী আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুদের নানা সমস্যা, তাদের চিকিৎসা ও জীবন যাপনের উন্নতির লক্ষ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা সাধন করার জন্য এ দিবসটি পালিত হয়। এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- Friendship and Inclusion’ বাংলায়- “বন্ধুত্ব ও অন্তর্ভুক্তকরণ”। এই প্রতিপাদ্যের বিষয়ে এ ধারণায় দিচ্ছে যে, খিঁচুনী একটি স্নায়ু সমস্যা নব-জাতক থেকে শিশু, যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাই খিঁচুনীতে আক্রান্ত হতে পারে। এটা এক ধরণের Morbidity বা প্রতিবন্ধকতা। উন্নত চিকিৎসা বা ব্যবস্থাপনার কারণে শিশু মৃত্যুসহ অন্যান্য মৃত্যু হার কমে গেলেও ঐ ধরনের মানুষের কিছুটা অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। খিঁচুনী এক ধরনের অস্বাভাবিকতার বহিপ্রকাশ। তবে এরা সমাজের মানুষ। তাদের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং সর্ব ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে দেশ বা সমাজ এ সমস্ত ব্যক্তিবর্গ থেকে অনেক ভালো কিছু লাভ করতে পারে যা দেশ বা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি একজন শিশু নিউরোলজিস্ট তাই শিশুর খিঁচুনী এবং করোনা পরিস্থিতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করবো।
শিশুদের খিঁচুনীর উপসর্গ, বড়দের খিঁচুনীর উপসর্গের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতর। খিঁচুনীর প্রকৃতি ও প্রকারভেদও ভিন্ন হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় চিকিৎসা দেয়া হলে শিশুর খিঁচুনী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যায়। তবে খিঁচুনী থাকলে অবশ্যই খিঁচুনীর ঔষধ খাওয়াতে হবে। কমপক্ষে ২ বৎসর এমনকি কিছু ওষুধ সারা জীবনের জন্য খেতে হয়। অনেক খিঁচুনীতে একটা ঔষধে কন্ট্রোল হয় না। ২ বা ৩ টা ঔষধ দিতে হয়। কারোও বা খিঁচুনীর মাত্রা বেড়ে গেলে ওষুধের মাত্রাও বাড়াতে হয়। কিছু কিছু ওষুধ আছে যাহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে হয়। মোট কথা কোন শিশু যদি খিঁচুনীর জন্য ঔষধ খেয়ে থাকে তাহলে শিশুকে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। খিঁচুনীতে আক্রান্ত শিশু অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা থাকতে পারে। যেমন- অটিজম, অতি চঞ্চলতা, মানসিক সমস্যা, শারীরিক সমস্যা অন্যতম। এ সকল সমস্যার জন্য অভিভাবকদের বাড়তি খরচ করতে হয় বা থেরাপি দিতে হয়। অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রায় হাজারের অধিক শিশু আছে তারা কোন না কোন খিঁচুনীতে আক্রান্ত। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খিঁচুনীতে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকদের দুশ্চিন্তায় পড়ার কথা। আবার খিঁচুনীর ওষুধ সব জায়গায় পাওয়া যায় না। এন্টিবায়োটিক ওষুধের মত এই ওষুধ সব ফার্মেসীতে থাকে না। কিছু কিছু ওষুধের দামও বেশি বা ঐ ওষুধ অনেকদিন ধরে খাওয়াতে হয় বলে মা বাবার উপর অর্থনৈতিক চাপ পড়ে। খিঁচুনী আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক শিশুর থেকে সাধারণ কিছু রোগে যেমন- সর্দি, কাঁশি, নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়া রোগে বেশি ভোগে। এতেও ঔষধ কেনার চাপটা অভিভাবকদের উপর থাকে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবক তাদের শিশুদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তায়, বিশেষ করে উপজেলাতে যে সমস্ত শিশুরা বাস করছে তাদের পক্ষে ঔষধ পাওয়া খুবই কস্টকর হয়। অনেক শিশুর ফলোআপের প্রয়োজন কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারছে না। কিছু কিছু শিশুর হঠাৎ খিঁচুনী শুরু হয়ে গেলে তা কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটা পরিবারের জন্য অসুবিধা হয়।
এসমস্ত অসুবিধা বিবেচনায় রেখে অভিভাবকদের অনুরোধ করছি সারা পৃথিবী এখন মরণব্যাধী করোনার কারণে ভয়ানক অবস্থায় আছে। তা থেকে আপনি বা আপনার পরিবার ও শিশুরা নিরাপদে থাকুন সাহস করে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে থাকুন। অনুরোধ করবো কোন অবস্থায় ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। অনেক অভিভাবক ওষুধ চলাকালে খিঁচুনী বন্ধ থাকলে তারা ঔষধ বন্ধ করে দেয়। মনে করে আর খিঁচুনী হবে না। কিন্তু মাস খানিক পর পুনরায় খিঁচুনী শুরু হয়। তাই খিঁচুনীর ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। তবে যে ওষুধ কোম্পানীর ওষুধ আপনারা শিশুকে খাওয়াচ্ছেন তা পাওয়া না গেলে অন্য কোম্পানীর একই জেনেরিক ওষুধ খাওয়াতে পারেন। এক সাথে অনেক ওষুধ কিনে রাখবেন। আমাদের দেশে সাধারনতঃ খিঁচুনীর ওষুধ সিরাপ বা বড়িতে পাওয়া যায়। তাই মাত্রা ঠিক রেখে সিরাপ বা বড়ি যে কোন একটা খাওয়ালে হবে। যারা বিদেশী ওষুধ খাওয়াচ্ছেন তারা বাংলাদেশী একই ওষুধ খাওয়াতে পারবেন। কার্যকারীতার কোন সমস্যা হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে খিঁচুনীতে আক্রান্ত শিশুদের হাসিখুশিতে রাখবেন। ঘরে সামান্য ব্যায়াম বা খেলাধুলা করাবেন। বেশিক্ষণ টেলিভিশন দেখতে দিবেন না বা অনিদ্রায় যাতে বেশি না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখবেন। গরম পানি বা সুপ খাওয়াবেন। ভিটামিন যুক্ত খাবার খাওয়াবেন। প্রয়োজনে মাল্টিভিটামিন ও জিংক খাওয়াবেন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম বর্তমানে চালু আছে। আপনারা পূর্বের ন্যায় চিকিৎসা বা থেরাপীষ্টদের সাহায্য নিতে পারেন। প্রয়োজনে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও আপনার শিশুর সমস্যার সমাধান করতে পারেন। মোবাইল- ০১৮৪২৪৫৭৪৪৭, টেলিফোন- ০৩১-৭১১২৩৬, ২৫২০০৬৩ (এক্স-১২২) সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ সেবা চালু আছে। কিছু দিনের মধ্যে বৈকালিক সেবাক্রম বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সকল সেবা চালু থাকবে। পরিশেষে বলব হতাশ হবেন না, কালো মেঘ কেটে যাবে। আমরা শিশুদের সুন্দর ও সুখময় জীবন প্রত্যাশা করছি।

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র,
চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মহনন ও তার প্রতিরোধ
পরবর্তী নিবন্ধভাষা, জাতি ও জাতিরাষ্ট্র