বিশ্ব অর্থনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি : মার্কিন ডলার

কৃষ্ণ কুমার শর্মা | মঙ্গলবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে মার্কিন ডলার তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রিজার্ভ মুদ্রা, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিদ্যমান, যা অন্য কোনো প্রধান মুদ্রার ক্ষেত্রে এখনো অনুপস্থিত। গত কয়েক দশক ধরে ইউরো, ইয়েন এবং চীনের ইউয়ান ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করলেও, মার্কিন ডলার তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, গভীর এবং তরল আর্থিক বাজার, তুলনামূলক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত গ্রহণযোগ্যতার কারণে এখনো বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বহাল রয়েছে। এই বিস্তারিত প্রবন্ধে আমরা বর্তমান বিশ্ব ব্যবসায় মার্কিন ডলারের ক্ষমতা ও প্রভাবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করব এবং খতিয়ে দেখব কেন নিকট ভবিষ্যতে এর এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান অক্ষুণ্ন থাকার সম্ভাবনা প্রবল এবং অন্য কোনো মুদ্রা, বিশেষত চীনের ইউয়ান, কেন এই মুহূর্তে ডলারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারছে না। আমরা ডলারের ক্ষমতার উৎস, বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

মার্কিন ডলার এর বিশ্ব মঞ্চে আজকের এই প্রভাবশালী অবস্থানে আসা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যা বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে গভীরভাবে জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা স্তিমিত হওয়ার পর, বিশ্ব একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সেই প্রেক্ষাপটে, ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসে ৪৪টি মিত্রশক্তির প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে একটি স্থিতিশীল বিনিময় হার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা ব্রেটন উডস চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল স্তম্ভ ছিল মার্কিন ডলার, যাকে স্বর্ণের সাথে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে (প্রতি আউন্স ৩৫ ডলার) বিনিময়যোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর মুদ্রা ডলারের সাথে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হারে আবদ্ধ হয়। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ, ডলার দ্রুতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম এবং বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয়। ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর স্থাপনও ডলারের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক আর্থিক নীতি নির্ধারণ এবং ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ডলারকে প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত।

১৯৭১ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিঙন স্বর্ণের সাথে ডলারের বিনিময় প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করেন (‘Nixon Shock’ নামে পরিচিত), তখন অনেকেই ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তবে, ততদিনে ডলার বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক লেনদেন, বাণিজ্য এবং সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ডলারের উপর যে আস্থা তৈরি হয়েছিল, তা রাতারাতি ভেঙে পড়েনি। বরং, ডলার তার অর্জিত বিশ্বাসযোগ্যতা, মার্কিন অর্থনীতির বিশাল আকার এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের সুবিধার কারণে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ব্রেটন উডস ব্যবস্থা ভেঙে গেলেও, ডলার তার উত্তরাধিকার এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক অবকাঠামোতে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখে এবং ফ্লোটিং এঙচেঞ্জ রেট ব্যবস্থা চালু হলেও ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হিসেবে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

আজকের বিশ্বায়নের যুগে, মার্কিন ডলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মার্কিন ডলারে সংরক্ষণ করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সর্বশেষ পরিসংখ্যান (২০২৪ সালের শেষভাগ অনুযায়ী) অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশ এখনো মার্কিন ডলারে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো ডলারের দীর্ঘদিনের স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক লেনদেনে এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং মার্কিন ট্রেজারি বিলের মতো নিরাপদ ও সহজে বিনিময়যোগ্য (তরল) সম্পদের সহজলভ্যতা। ইউরো (প্রায় ২০ শতাংশ), জাপানি ইয়েন (প্রায় ৫ শতাংশ), ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং (প্রায় ৫ শতাংশ), এবং কানাডিয়ান ডলার ও অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মতো অন্যান্য প্রধান মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রার তালিকায় থাকলেও ডলারের ধারেকাছেও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূলত ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য এই রিজার্ভ ব্যবহার করে, এবং ডলার এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সুবিধাজনক বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। ডলারের গভীর এবং তরল বাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত এবং সহজে তাদের রিজার্ভ কেনাবেচা করার সুযোগ দেয়, যা অন্য কোনো মুদ্রার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কঠিন। এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী আর্থিক প্রবিধান এবং আইনি কাঠামো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ প্রদান করে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার এখনো প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে, অপরিশোধিত তেল (যা ‘পেট্রো ডলার’ নামে পরিচিত), স্বর্ণ এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং লেনদেন মূলত ডলারে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের চালান ডলারে প্রস্তুত করে। এমনকি যখন দুটি ভিন্ন দেশ যাদের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে, তাদের মধ্যে বাণিজ্য সংঘটিত হয়, তখনও প্রায়শই ডলার মধ্যস্থতাকারী মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর কারণ হলো ডলারের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকার দীর্ঘ প্রবণতা, যা লেনদেনকে সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত করে তোলে। শিপিং, বীমা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত পরিষেবাগুলোর মূল্য নির্ধারণও প্রায়শই ডলারে হয়ে থাকে। এই ব্যাপক ব্যবহার ডলারকে বিশ্ব বাণিজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে এবং এর বিকল্প খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক চুক্তি এবং নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ডলারের ব্যবহার একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির অন্যতম এবং এখানে একটি অত্যন্ত উন্নত, গভীর ও তরল আর্থিক বাজার বিদ্যমান। এই কারণে, বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারভিত্তিক বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। বন্ড, স্টক এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণে বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ডলারে হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি কাঠামো বিনিয়োগের জন্য একটি নিরাপদ ও আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করে, যা ডলারের চাহিদা এবং মূল্যকে আরও বৃদ্ধি করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কারণ এখানে সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত এবং আর্থিক লেনদেনের নিয়মকানুন স্পষ্ট ও কার্যকর। এছাড়াও, মার্কিন শেয়ারবাজারের আকার এবং বৈচিত্র্য বিনিয়োগকারীদের জন্য বিস্তৃত সুযোগের সৃষ্টি করে এবং উন্নত কর্পোরেট গভর্ন্যান্স বিনিয়োগের ঝুঁকি কমায়।

মার্কিন ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষত চীনের ইউয়ান এবং ইউরো থেকে। তবে, এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ডলারের শক্তি এবং এর বিপুল বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা সহজেই পরিত্যক্ত বা প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। চীনের ইউয়ান আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেষ্টা করলেও, তার আঞ্চলিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেই তা সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ইউয়ানের ভবিষ্যত বৃদ্ধির জন্য অনেক বাধা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চীনের আর্থিক বাজারের অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অনিশ্চয়তা। মার্কিন ডলারের মতো বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে ইউয়ান বা ইউরোকে অনেক দূর যেতে হবে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মুদ্রা বা ডলারের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ না তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রবৃদ্ধি লাভ করে। মার্কিন ডলারের আধিপত্য আগামী কয়েক দশক পর্যন্ত অটুট থাকবে এমন সম্ভাবনা প্রবল।

লেখক: কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবই নয়, যেন হীরের টুকরো
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত