বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর ব্যাপক সংকটে অন্যান্য সমস্যার সাথে সাথে নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ আর্থিক সংকটের কারণেই এই সমস্যাটি চরম আকার ধারণ করেছে। নারী ও কন্যা শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী ১৬ দিনের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নারীর ভূমিকায় নারীই অনন্য। পৃথিবী সৃষ্টি হতে আজ অবধি নারীরা তাদের মেধা-শ্রম-যোগ্যতা-দক্ষতা ও সর্বোপরি মায়া-মমতা ভালোবাসায় অগ্রযাত্রার পথকে সুগম করেছে।
একটি পরিবারকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব একজন স্ত্রী ও মায়ের উপর নির্ভর করে। নিজের শক্তি সামর্থ্য – ধৈর্য্য- শিক্ষা নিয়ে একজন নারী তার সংসারটি সাজাতে থাকে। আর্থিক সমর্থন ও সহযোগগিতায় এই কাজটি অনেক সহজ হয়। আবার একজন চাকুরীজীবী মহিলার দুই ধরনের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। পরিবার ও চাকুরীর ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এগোতে হয়। যা চাকুরীজীবী মহিলার বিচক্ষণতাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলা হয়। প্রাত্যহিক সাংসারিক কাজে একজন মহিলার শ্রম ও মেধার হিসাব করতে গেলে আদৌ সঠিক পরিমাণ ও পরিমাপ সম্ভব নয়। কোন ধরনের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয় বরং গভীর ভালবাসায় একজন নারী তার সংসারের জন্য খেটে যান। তবু প্রশ্ন করা হয় নারী তোমার বাড়ি কোনটি? কখনো বাবার বাড়ি, কখনো শ্বশুর বাড়ি, কখনো স্বামীর বাড়ি ও কখনো সন্তানের বাড়িতে নারীর জীবন যুদ্ধ শেষ হয়। নিজের বাড়ির পরিচয় দিতে পারে না, আবার অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে জীবনের পড়ন্ত সময় কাটাতে বাধ্য হয়। নারীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে গণ্য করা হলেই যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব। বিভিন্ন সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীরাই প্রথমে ভুক্তভোগী। একটি পরিবারের কেউ অসুস্থ অথবা দুর্ঘটনায় পতিত হলে সেই সংসারের নারীকে অধিকাংশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মায়ের মায়া-মমতা-আদর-স্নেহে সকল মূল্যকে অমূল্য করে তোলে। তাইতো কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই নারীরা কষ্ট করে যায়। পরিবারে নারীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বার বার প্রবাস ফেরত নারীদের বিষয়টি মনে পড়ছে। এরই মধ্যে অনেক নারী প্রবাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়ে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। প্রবাসে যাওয়ার আগে নিজের জমানো টাকা-পয়সা ও সহায়-সম্বল বিক্রি করে সোনার হরিণের আশায় বিদেশ পাড়ি দিলেও অসহায়ের কপালের দুঃখ মোচন হওয়ার নয়। একটি উন্নত জীবনের আশায় বিশেষ করে স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় নারীদের একটি অংশ বিদেশে চাকুরী করতে যায়। আমরা তাদের প্রবাসী নারী শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। তারা দেশে একটি নির্দিষ্ট অংশের রেমিটেন্স পাঠাতে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন খবর ও পত্র-পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে নারী শ্রমিকদের উপর যে হারে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালানো হয় তাতে আমাদের রাষ্ট্রের প্রবাসী কল্যাণ সংস্থাকে আরো বেশী কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। প্রবাসে কর্মরত নারী শ্রমিকরা যখন আবার দেশে ফিরে আসেন তখন পরিবার ও সমাজ তাদেরকে সহজে মেনে নিতে পারে না। যাদের সুখের আশায় আপন পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে সেই আপনজনরাই তখন তাদেরকে মেনে নিতে চায় না। আমাদের দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালতে কর্মরত নারীরা তাদের চলার পথে যেমন নানান ভাবে হেনস্থা হতে থাকেন তেমনি অফিস পাড়ায় নানান ভাবে তারা হেনস্থার শিকার হচ্ছে। আমাদের কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষির সাথে নারীরা সম্পৃক্ত। অথচ একজন কৃষককে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, একজন কৃষানীকে সেই ভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। কৃষকের ন্যায্য পাওনা ও দাবিগুলোকে বড় করে দেখা হয়। কিন্তু অন্তরালে একজন কৃষানী শ্রম দিয়ে ও সময় ব্যয় করে কৃষকের উৎপাদনকে তরান্বিত করে। মাদক ব্যবসার সাথে অনেক নারীই জড়িত। কিন্তু এর নেপথ্যের কাহিনী ভীষণ করুণ। পুরুষ কেন্দ্রীক সমাজের লোভ-লালসার শিকার হয়ে অনেক নারী বাধ্য হয়ে অপরাধ জগতে জড়িয়ে যায়। উন্নয়নের জোয়ারে প্রতি নিয়ত রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ চলে। প্রতিটি শহরে বড় বড় রাস্তাগুলো তৈরীর পিছনে নারী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। রাস্তা তৈরী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেরামতে নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে চলছে। আমাদের দেশের প্রতিটি ফ্লাইওভারের নির্মাণে নারী শ্রমিকদের ঘামের স্পর্শ লেগে আছে। তাদের রক্ত পানি করা ঘামের মূল্য শুধু অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু এই নারী শ্রমিকরা আবার ঘরে ফিরে একজন স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা পালন করে। বড় বড় সেই কালভার্ট তৈরী থেকে শুরু করে আধুনিক শহরের বড় বড় আলিশান ফ্ল্যাট বাড়ীর নির্মাণ কৌশলে নারী শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছে। তাদেরকেও নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তারা তাদের উপার্জিত অর্থ নিজেদের ইচ্ছামত খরচ করতে পারে না। স্বামীর ইচ্ছামতই তাদের সেই অর্থ ব্যয় হয়। আর যারা একাই সংসার চালাচ্ছেন তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ের উপার্জিত অর্থ ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়। নিজের জন্য কিছু থাকে না। তাছাড়া আমাদের পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত নারী শ্রমিকদের পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি এখন চিন্তার বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নারী শ্রমিকরা নিরাপত্তা জনিত ভয়ে দিন কাটাতে হয়। আমাদের দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিউটি পার্লারের অনেক নারী শ্রমিক আছে। এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রতি কয়েকজন স্কুল শিক্ষিকার শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। ফলে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের নিরাপত্তা জনিত বিষয়টি বার বার আমাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ করছে। বিশাল নারী শক্তিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে আমাদের উন্নয়নের গতিধারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কবির ভাষায় বলতে হয় – ‘‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’’ পৃথিবীর প্রত্যেকটি নারী যাতে একটি নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশে নিজেকে বিকশিত করতে পারে তার জন্য প্রতিটি পুরুষকে ইতিবাচক ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। যুগের পর যুগ স্ত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সংসারের উন্নয়ন ধারায় অবদান রেখেছেন। ইতিহাস বলে, বিভিন্ন রাজা ও বাদশার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে স্ত্রীর ভূমিকা অনন্য। বর্তমান বিশ্বেও অনেক নারী নেতৃস্থানীয় পদে আসীন হয়ে তাদের বিচক্ষনতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষন পেলে নারীরাও এগিয়ে আসতে পারে। সেই সুযোগ সৃষ্টির পিছনে সবার ইতিবাচক ভূমিকা কাম্য।
আমাদের সমাজে একজন মাকে যে সম্মান দেওয়া হয় এবং একজন কন্যাকে যে আদর দেওয়া হয় সেই সম্মান ও আদর একজন স্ত্রীকে দেওয়া হয়না। একজন স্ত্রী প্রথম জীবনে স্বামী ও নতুন শশুর বাড়ীর আত্নীয় স্বজনের সকল আদর আপ্যায়নে নতুন জীবনের সুখকর দিনগুলো পার করে। অতপর একজন নতুন মায়ের স্বপ্নে ও সংসারের গতিশীলতা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। ধাপে ধাপে একজন সদ্য বিবাহিতা নারীর ভূমিকা মধ্যবয়স পেরিয়ে বৃদ্ধ বয়সে উপস্থিত হয়ে থাকেন। প্রতিটি ধাপেই একজন নারী স্বামী ও সন্তানের সুরক্ষায় ত্যাগ স্বীকার করে থাকে। যে কোন দুর্যোগে একজন নারী মায়ের ভূমিকায় সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেন। যে কোন আর্থ- সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে একজন নারী স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকায় তার যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে থাকে। এমন কি যে কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কবলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে একজন নারীকেই সকল সমস্যার ও ক্ষতির প্রতিশোধে এগিয়ে আসতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের সম্মানহানির ঘটনাগুলো আমাদেরই ব্যর্থতা। নারীকে শুধু নারী নয়, মেয়ে মানুষ নয়, একজন মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে পারলেই সমাজে সত্যিকারের মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
পৃথিবীর সকল সংকটের সময়ে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা সকল ধরনের সমস্যা-সমাধানের পথ সহজ করে তোলে। এই করোনাকালীন নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ নারীর প্রতিটি সহিংসতার ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। তাই নারীরা যেন প্রতিটি ক্ষণ-দিন সময়ে নিরাপদে থাকে, তার জন্য আমাদের সকলের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ,
হালিশহর, চট্টগ্রাম