জগতে সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণীকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। জীবন প্রবাহ সচল রাখার জন্য পরিপূর্ণ পুষ্টির প্রয়োজন। আর পর্যাপ্ত পুষ্টি বা ক্যালরি প্রাণীকে সচল রাখে এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মানুষ নামক প্রাণীটির কর্মক্ষমতাকে সচল রাখার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য গ্রহণ মানুষের শরীরকে সচল রাখে। বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য গ্রহণের মধ্যে প্রধান খাদ্য বলে একটি কথা আছে। স্থান, কাল ও অঞ্চল ভেদে এক এক দেশের বা এক এক অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য এক এক প্রকারের হয়। কোনো অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য রুটি বা আটা। আবার কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত বা চাল। পৃথিবীতে এমন কিছু অঞ্চল বা দেশ আছে যাদের প্রধান খাদ্য আলু। তবে এরূপ অঞ্চলের পরিমাণ খুবই কম। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে চাল বা আটা। আবার চাল ও আটা পাওয়া যায় ধান ও গম হতে। এ কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ধান ও গম উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে একটি পুরানো প্রবাদ চালু আছে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। আবার পশ্চিমারা অনেকটা উপহাস করে বলে থাকে ‘ভেতো বাঙালি’। যে যাই বলুক, বাংলাদেশীদের ভাত না খেলে চলে না। এ কারণে বাংলাদেশের প্রধান উৎপাদিত ফসল হচ্ছে ধান। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে প্রতি অর্থবছরে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টন চাল এর প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো সময় চালের উৎপাদন ভালো হলেও চাহিদা অনুসারে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয় না। এক হিসেবে দেখা গেছে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রায় সময় এদেশে চালের তথা খাদ্যে ঘাটতি থেকে যায়। সে কারণে বর্তমান চাহিদাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশকে কমবেশি ২০ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। অথচ বিশ্বের চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিগত দশকে দেখা গেছে চালের উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে কয়েক বছর চাল আমদানি করতে হয়নি। বরং সুগন্ধী জাতীয় কিছু চাল রপ্তানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের সবকয়টি খাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও এখনো অনুন্নত দেশের কাতারে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশে গমন করার জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করলেও এখনো সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের কাছে অনুন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। এদেশের প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের সম্পূর্ণ খাদ্য জোগানোর ভার বহন করছে এদেশের কৃষি তথা দরিদ্র কৃষক সমাজ। মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এর তথ্যানুযায়ী ২০২৩–২৪ অর্থ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫২ কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এই উৎপাদন তার আগের অর্থ বছরের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি। মার্কিন কৃষি বিভাগের তথ্য থেকে আরো জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ ১০ বছরে বাংলাদেশে গড়ে সাড়ে ৩ কোটি ৯০ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থ বছরে বিশ্বের মোট চাল উৎপাদনের ৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ হয় ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। বিগত ২০২২–২৩ অর্থ বছরের তুলনায় ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে ২ শতাংশ।
২০২৩–২৪ অর্থ বছরে বিশ্বের কোন দেশে কী পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছিল তা নিয়ে আমেরিকার কৃষি বিভাগ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই তথ্য অনুসারে ২০২৩–২৪ অর্থবচরে বিশ্বের মোট উৎপাদিত চালের ২৮ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে চীনে। এ সময়ে চাল উৎপাদনের পরিমাণ হয় ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। যদিও ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় এই উৎপাদন দশমিক ৯১ শতাংশ কম। অর্থাৎ বিশ্বের চাল উৎপাদনে ১ম স্থান দখল করেছে চীন। অপরপক্ষে দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারতে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ১৩ কোটি ৭৮ লক্ষ টন যা বিশ্বের মোট উৎপাদিত চালের ২৬ শতাংশ। বিশ্বের চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। চতুর্থ স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ইন্দোনেশিয়াতে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টন। বিশ্বের চাল উৎপাদনে পশ্চম স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এ দেশে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টন। চাল উৎপাদনে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে থাইল্যান্ডে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি টন। সপ্তম স্থানে রয়েছে ফিলিপাইনস। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ফিলিপাইনস এ মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এর পরবর্তী অষ্টম স্থান দখল করেছে মিয়ানমার। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মিয়ানমারে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ টন। আর চাল উৎপাদনে নবম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। এ দেশটিতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে শুধুমাত্র ৯৮ লাখ টন। আর দশম স্থানে রয়েছে কম্বোডিয়া। এ দেশটিতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৭৪ লক্ষ টন। আর বিশ্বে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ হয় ৫২ কোটি টন।
বিশ্বের মানুষের খাদ্যাভ্যাস যেহেতু এক নয় সেহেতু যেসব দেশের প্রধান খাদ্য ভাত সেই সব দেশেই অধিক চাল উৎপাদন হয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যাভ্যাস চাল। তাই অনেকদিন পর চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান দখল করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর’২৪) জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে (Gross Domestic Product) কৃষি খাতের অবদান ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপিতে এ খাতে অবদান ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে।
গত বছর দুই দফা বন্যায় দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি খাতের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। বন্যা ও অতি বৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ কৃষি খাত, ফল– ফসল ও প্রাণী–সম্পদ ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দরিদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীকে ঋণ সহায়তা বা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, গ্রামে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিকট থেকে সঞ্চয় আকারে আমানত সংগ্রহ করে। আর সেই সব আমানতকৃত টাকা বৃহৎ আকারে ঋণ পেয়েছে শহরাঞ্চলের বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। আবার গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তথা কৃষকদের ছোট ছোট আমানতগুলো শহরাঞ্চলের শিল্পপতিদের ঋণ আকারে দিয়ে সেই ঋণ আর ফেরৎ পাচ্ছে না ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের আমানত প্রবাহকে নিয়ে আসা হয়েছে শহরে। অথচ সেই ঋণের সিংহভাগই এখন ঋণ খেলাপী।
সর্বশেষ বন্যায় বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব এলাকার কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, বন্যার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণদানসহ নানা দাবিতে বেশ কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি দিলেও এখনো কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে জড়িত গ্রামীণ অর্থনীতির বিশাল এ খাতকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য কাজ। হয়তো খাদ্য তথা চাল উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক: কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।