এই গতিশীল বিশ্বে একটা দেশের অবস্থান কোথায় হবে, তা অনেকাংশে সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেমন চলছে বা যোগ্য নাগরিক তৈরিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। যে কোন উন্নত দেশের দিকে তাকালে সেই সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মানও সামনে চলে আসে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। এই যে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, এই আন্দোলনের সূতীকাগারও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়। এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ছাত্র সমাজ– যা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের Product বা চালিকা শক্তি। এই ছাত্র সমাজকে আমরা যদি সঠিক নির্দেশনা বা উৎকৃষ্ট জ্ঞান দিতে পারি তাহলে তারা পুরো বিশ্বে বাংলাদেশকে জানান দিতে সক্ষম। আমাদের বেশির ভাগ ছাত্র–ছাত্রী যখন উচ্চ শিক্ষার্থে বা পেশাগত কারণে বিদেশ যায়, তারা সেখানে মেধার চমৎকার স্বাক্ষর রাখে এবং স্ব স্ব পদে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত কাজ করে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় এখানে পারছে না কেন? কারণ আমি মনে করি System বা ব্যবস্থা অথবা পদ্ধতি। এই ব্যবস্থা বা পদ্ধতি কিন্তু ছাত্র–ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা করে বা জানতে পারে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান আহরণ বা জ্ঞান চর্চার পিরামিডের সর্বোচ্চ ধাপ। তাই নাম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, কাজও বিশ্ব মানের হতে হবে। এই যে, বিশ্বমান এখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার বিশ্বমানের লোক। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে উপাচার্য হচ্ছেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ব্যক্তি। যিনি তার নেতৃত্বে গুণ, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং বহুমুখী পারদর্শিতা দিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একজন প্রকৃত উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দিন এবং রাতের মত তফাৎ নিয়ে আসতে পারে। আমাদের ছাত্র সমাজ/বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। একজন উপযুক্ত উপাচার্য এর হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ন্যাস্ত হলে আমাদের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের হওয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ আমরা সকলে ছোট থেকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে বড় হয়েছি। আমরা সবাই কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত। কথাগুলো এখন বলার সময় এসেছে কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আজকের দিন (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট) পর্যন্ত ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন, সাথে আরও আছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ স্থানীয় প্রধানগণ। বিশ্বের কোন দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ নজিরবিহীন। এমনকি জানা মতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়নি। এতে বুঝা যায় যে, এ সমস্ত উপাচার্য কি পরিমাণ দলকানা ছিলেন। এদের দিয়ে এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে চলেছে তা তাদের পদত্যাগ থেকে সহজে অনুমান করা যায়। অথচ একজন উপাচার্য সমাজ এবং একটা দেশের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হতে পারতো। সারা বিশ্বে উপাচার্যগণদের বক্তব্য বা দিক নির্দেশনা শুনার জন্য ছাত্র–ছাত্রী বা সংশ্লিষ্ট সমাজের নীতি নির্ধারকসহ সবাই আসতেন দিক নির্দেশনা নেওয়ার জন্য। অথচ আমাদের এখানে উপাচার্যবৃন্দ পদ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে দিনের পর দিন ধর্না দিয়ে আসছেন। একবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষামন্ত্রীর একটা মিটিং এ যোগদানের সুযোগ হয়ে ছিল। সেখানে পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রীর আগের জন বলেছিলেন ভাল শিক্ষকরা (যারা দক্ষ) তার উপাচার্য হতে চায় না। কিন্তু উনি এটা উপলদ্ধি করেন নাই, যে পদ্ধতিতে প্রচলিত উপাচার্য নিয়োগ দিতেন (তদবীর প্রক্রিয়ায়) সেই পদ্ধতিতে কোন ভাল অথবা দক্ষ শিক্ষক যাবেন না। কারণ কোন শিক্ষক সত্যিকার অর্থে উপাচার্য পদের জন্য যোগ্য বা দক্ষ হলে সে তদবীর বা কাউকে তোষামোদী করে পদ পেতে চাইবেন না। সত্যিকার যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে উক্ত পদ অলংকৃত করতে হয়। বর্তমান বিশ্ব সম্পূর্ণরূপে মেধার ওপর নির্ভরশীল। তাই উন্নতির শিকড়ে থাকা অনেক দেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন কি দেশ জাতি ধর্ম বর্ণ কোন কিছুই বিবেচনায় আনেন না। শুধুমাত্র মেধা এবং নেতৃত্ব গুণকেই বিবেচনায় নেয়। একজন প্রকৃত উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব মানে নিয়ে যেতে পারে এবং অন্যান্য দেশের জন্য ঐ বিশ্ববিদালয়কে আর্কষনের কেন্দ্র বিন্দু বানাতে পারে। এক সময় আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মালয়েশিয়া, সার্কভুক্ত দেশসমূহ এবং আরও বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি ছাত্র–ছাত্রীরা পড়তে আসত। কিন্তু উপাচার্যরা দলীয় রাজনীতি আওতায় নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে শিক্ষার মান নেমে যেতে শুরু করে। এমনকি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যেখানে সাধারণ মানুষ মনে করে উপাচার্য মানে দলীয় মানুষ এবং উপাচার্য শুনলে মানুষ জ্ঞানী/ভাল মানুষ মনে করে না। যেহেতু বর্তমান ছাত্র–জনতার ঐতিহাসিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি এবং সাথে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে পেয়েছি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারকে। বর্তমানে তিনি শিক্ষা উপদেষ্টাও বটে। অধ্যাপক ড. ইউনূস স্যার নিজেও এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য পদে কর্মরত ছিলেন বা আছেন তাই আমরা আশা করতে পারি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সত্যিকার যোগ্য অধ্যাপককে খুঁজে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিবেন। আমাদের প্রত্যাশা উপাচার্য নিয়োগের আন্তর্জাতিক মান বিবেচনা করে সিলেকশান পদ্ধতি নির্ধারণ করা এবং একটা সার্চ কমিটি গঠনপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকদের মাঝ থেকে আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে। এতে যারা আগ্রহী বা নিজেকে যোগ্য মনে করে তারা সবাই (ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে) আবেদন করতে পারবে। উক্ত আবেদনসমূহ থেকে বিভিন্ন স্তরে সাক্ষাৎকার, প্রেজেন্টেশন, মিশন, ভিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সামনের ০৪ বছরের ভাবনা বা লক্ষ্য, আন্তর্জাতিক কোলাবেরাশন, রিসার্চ, উচ্চ শিক্ষাসহ বিভিন্ন স্কিল বিবেচনাপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কাউকে দিতে (যদি যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া না যায় সে ক্ষেত্রে বাহির থেকে দেওয়া যায়) পারলে ভাল হয়। মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক এক একটি প্রতিষ্ঠান তুল্য। উপযুক্ত উপাচার্যই পারে এই সকল শিক্ষকদের জ্ঞানের স্ফূরণকে একত্রিত করে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা। যেখানে আমাদের সকল সমস্যা আমাদের দেশীয় মানুষরা সমাধান করবো এবং প্রয়োজনে অন্য দেশগুলোকে কারিগরি অথবা জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করবে। পরিশেষে ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্যার এর ভাষায় বলবো বাংলাদেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে স্বপ্ন তা আমাদেরও স্বপ্ন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমরা অবশ্যই সেই স্বপের্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট); প্রকল্প পরিচালক, চুয়েট নরপার্ট কেয়ার প্রকল্প, নরওয়ে। এবং ভিজিটিং রিসার্চার, হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটি, জাপান।