প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। আবার অনেকেই অনেক কম পয়েন্ট নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। যারা ভালো রেজাল্ট করছে তাদের পাশাপাশি অকৃতকার্য ও কম পয়েন্ট নিয়ে পুনরায় ভর্তি হচ্ছে তাদেরকে আরও কীভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় সে বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ করা জরুরি। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের সাথে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প কারখানার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কীভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়টি নীতি–নির্ধারকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। কখন পড়াশোনা জরুরি? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, রিসার্চ–বেইজড ক্যারিয়ার, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক ইত্যাদি পেশার জন্য উচ্চ শিক্ষা কিংবা ডিগ্রি দরকার।
এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা পড়াশোনায় দুর্বল কিন্তু হাতের কাজে অনেক দক্ষ। এমন শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনায় ( উচ্চ শিক্ষা) না গিয়ে তাদেরকে যদি হাতে–কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তারা দেশের বোঝা না হয়ে বরং সম্পদে পরিণত হতে পারে। আমাদের দেশে অধিকাংশ তরুণদের লক্ষ্য শুধুমাত্র সরকারি চাকরি। তরুণদের এক বিশাল জনগোষ্ঠী যদি শুধুমাত্র সরকারি চাকরির পেছনে সময় ব্যয় করে তাহলে (গবেষক, বিজ্ঞানী ) উদ্যোক্তা হবে কে? একজন উদ্যোক্তা অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন, যা অন্য পেশাজীবীরা তা পারেন না। যেখানে উন্নত দেশগুলো তৈরি করে উদ্যোক্তা আর আমরা!
আমাদের দেশে অধিকাংশ কারিগরি প্রতিষ্ঠান দক্ষতা উন্নয়নের চেয়ে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট দেওয়ার মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছে। প্রতিদিন স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এর মূল কারণ কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব না দেয়া। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশ দুটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। সাথে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর দেশগুলোর কথা না বললেই নয়! দেশগুলো উন্নতি করার পেছনে প্রধান সোপান কারিগরি শিক্ষা।
আমাদের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে যদি এই ব্যবস্থাটা থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো। আমি নিশ্চিত এখান থেকে যারা কাজ শিখে বের হবে তারা কখনও অন্যের বোঝা হবে না। পাশাপাশি তাদের নেটওয়ার্কিং দক্ষতা বাড়বে। নেটওয়ার্কিং দক্ষতা যত ভালো হবে তত তৈরি হবে নতুন নতুন সুযোগ।
আপনারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন বর্তমানে যেখানে পুরো বিশ্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (AI) জয়জয়কার, সেখানে হাতের কাজ শেখাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আসলে কী জানেন, মানুষ যতই কৃত্রিমতার মাঝে গা ভাসিয়ে দিক না কেন তারপরও হাতের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কখনো কমবে না বরং বাড়বে! পুরো বিশ্ব যখন
এ আই এর উপর নির্ভরশীল তখন আমাদের তরুণদের হাতের তৈরি কাজগুলোর চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে। যদি আমরা তাদেরকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করতে পারি। এভাবে আমরাই পারি আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে।
কী কী বিষয় রাখা যেতে পারে এই প্রতিষ্ঠানে!
১. কম্পিউটার শিক্ষা: বর্তমান বিশ্বে কম্পিউটার পরিচালনার জ্ঞান ব্যতীত চাকরি বাজার নেই বললেই চলে। যাদের কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তারা কম্পিউটারের যত কাজ আছে তা শিখলো।
২. ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে একটি ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বাংলা, ইংরেজি, জাপানি, চীনা, জার্মান ভাষা, উর্দু, ফার্সি ভাষা, তুর্কি ভাষা, রুশ ভাষা ইত্যাদি । যার যেটা প্রয়োজন সে সে ভাষাটা শিখবে।
৩. মাটি ও বাঁশের তৈরি কারুকার্য শিল্প: যাদের মাটির কাজের প্রতি আগ্রহ তারা মৃৎশিল্পের কাজ শিখতে পারে। চীন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে ঠিক কিন্তু তারা মাটির কারুকার্য শিল্পকে এখনো ধরে রেখেছে। তেমনি বাঁশ গাছ থেকেও যে অনেক আধুনিক জিনিসপত্র বানানো সম্ভব তাও শিখলো। বেঁত গাছ থেকে যে পাটি।
৪. কৃষি: কৃষি হলো একটি দেশের প্রাণ। আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ হয়েও কৃষি শিক্ষা বিষয়টি আমরা এখনো একাডেমিক পড়াশোনায় যুক্ত করতে পারছি না। আলফা জেনারেশনকে কৃষি কাজে আগ্রহী করে তুলতে না পারলে বাংলাদেশের কৃষি পণ্য প্রায় আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে। তাই নতুন প্রজন্মের একটা অংশকে অত্যন্ত কৃষি কাজে দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
৫. প্লাস্টিক রিসাইকেলিং: প্লাস্টিকের ব্যবহার যে হারে বাড়ছে সে হারে বেড়ছে পরিবেশ দূষণও। তাই প্লাস্টিককে পুনরায় কীভাবে ব্যবহার করা যায় কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে যেসব জিনিসপত্র বানানো সম্ভব তার প্রশিক্ষণ।
৬. ওলের কাজ: নব্বই দশকের অনেকেই ওলের কাজের সাথে পরিচিত। অনেকেই সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরি করে এই ওল দিয়ে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এটির সাথে পরিচিত নয়। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের হয়তো মনে হবে এই হাতের কাজগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা গুরুত্ব কমে আসছে। আমাদের দেশে এর চাহিদা কম হতে পারে বিষয়টা তা নয় বরং বিদেশে আমাদের হাতের কাজগুলোর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বিশ্ববাজারে হাতের কাজগুলোর চাহিদা আরো বাড়বে কারণ সেখানে সবকিছু চলে গেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি–এর হাতে।
৭. পাটজাত পণ্য তৈরি : পাটজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই চাহিদাটা এনে দিতে পারে আমাদের জন্য এক অপার সম্ভাবনা। আমরা শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে পাটজাত পণ্য সামগ্রী তৈরিতে দক্ষ করে তুলতে পারি। যে দক্ষতা হবে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের।
৮. হোগলা পাতা : হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে অর্থনীতিতে। প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ হোগলা গাছ পেয়ে থাকে। এটি গ্রামীণ পরিবেশে বিশেষ করে নদীর দুই ধারে জন্মানো একটি পাতাসর্বস্ব গাছ। হোগলা পাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরির প্রশিক্ষণও রাখা যায়।
৯. জামদানী ও মসলিন : জেন জি বলেন, আর আলফা জেনারেশন বলেন! তারা কিন্তু জামদানী কিংবা মসলিন কাপড়ের সাথে তেমন পরিচিত না। অথচ এই দুটি কাপড় হলো আমাদের পুরনো এতিহ্য। আজ যে কারিগরেরা জামদানী ও মসলিন কাপড় তৈরি করছে আর কয়েক বছর পর তারা যখন থাকবে না তখন আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী কাপড়গুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিশ্বের বড় বড় ধনী দেশগুলো তারা তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে এবং তা ব্যবহারও করে। যদিওবা তারা এখন প্রায় সবকিছু তৈরি করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি বা এআই দিয়ে। কিন্তু নিজ দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
১০. নকশিকাঁথা: নকশিকাঁথা আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকি বাইরের দেশগুলোতেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই নকশিকাঁথার উপর প্রশিক্ষণ রাখতে পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১১.ঐতিহ্যবাহী খাবার: রান্না যে একটা আর্ট বা শিল্প এটা আমরা অধিকাংশ মানুষ জানিনা। আমাদের যত ঐতিহ্যবাহী খাবার আছে সেগুলোকে আমরা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারি। তাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো তৈরির প্রশিক্ষণ রাখা যায় এই প্রতিষ্ঠানে। যেমন: মেজবানি মাংস, খিচুড়ি, মধুভাত, বিনিভাতের পিঠা, পাঁচন।
আমাদের এখন খুব বেশি প্রয়োজন দক্ষ জনবল। কারণ আমরা যদি আমাদের জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের জন্য যে এক বিশাল বিপদ অপেক্ষা করছে তা মোকাবিলা করতে পারবো। এবার ভেবে দেখুন, একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে পড়তে আসত। এখন আমরা সেই দেশগুলোতে কাজের সন্ধানে যাচ্ছি। এর আরো আগের কথাই যদি বলি তাহলে দেখবেন প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের কিছু সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ভারতবর্ষে বহু বণিকরা এসেছিলেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। পরিশেষে বলা যায়, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্মানজনক স্থান অর্জন করতে হলে বিশ্বমানের কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
নোয়াপাড়া কলেজ, চট্টগ্রাম।