পরীক্ষা পদ্ধতি উচ্চশিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সঠিক গ্রেড প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা জানি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই নয়, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মূল্যায়ন যে কোনও শিক্ষাব্যবস্থায় ও স্তরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। পরীক্ষাগুলোর ফলাফল বা পারফরম্যান্স শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও সন্তুষ্টি দেয় এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার জন্য বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিফলিত করে।
বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন ভাইরাসটির ছড়ানোর প্রকৃতি ধীরে ধীরে জানা গেল, সাময়িকভাবে সমস্ত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ এড়াতে সরকারী নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলো ২০২০ এর মার্চে। শুরুতে ধারণা ছিল স্বল্পসময়ে কেটে যাবে ধাক্কা। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাসের ভয়বহতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায়, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে থাকে। এ অবস্থায় প্রযুক্তির সহায়তায় কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ আসে। ক্লাস চালিয়ে নিলেও পরীক্ষা নেওয়ার জায়গায় এসে আবার ধাক্কা। এ প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একাডেমিক লস কমানোর নিমিত্তে পরীক্ষা বন্ধ রেখে পরবর্তী সেমিস্টারের অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভাইরাসের প্রকোপ ধারাবাহিক কম-বেশী হতে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাবলিক পরীক্ষাও সময়মতো নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরীক্ষা গ্রহণ না করে এভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ভাবে ঝুলিয়ে রাখা নিরাপদ না। আবার পরীক্ষা না নিয়ে পূর্ববর্তী সম্পন্ন পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ফলাফল প্রকাশ ও যে সর্বজন গৃহীত বা স্বীকৃত না সেটাও আমরা দেখলাম এইচএসসি এর বেলায়। সত্যিকার অর্থে, সংক্রমণের ভয়বহতায় বিশাল জনসম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষাগুলি পুরোপুরি বাতিল করা ছাড়া সহজ বিকল্প ছিল না সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাতে। এবছরও অবস্থা অনেকটা পূর্বেকার ন্যায়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ঘোষিত সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কি না, তার নিশ্চয়তাও নেই। তখন কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এ সংকটের সময়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন অব্যাহত রাখতে পারে সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়া সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমে গতি আনতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া যায় কি না তার জন্য শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের গঠিত কমিটির সভা হয় সমপ্রতি। সভায় অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন পরীক্ষার প্রক্রিয়াটিকে স্ব স্ব একাডেমিক কাউন্সিলে অনুমোদন নিতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী জুলাই থেকে অনলাইনে সব বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে।
আমাদের দেশে এ পরিস্থিতির জন্য নতুন করে চিন্তা হলেও বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু করোনা মহামারী আঘাত হানার আগে থেকেই সাফল্যের সাথে অনলাইনে পরীক্ষার কার্যক্রম চালু ছিল। নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়, অসলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং আগদার বিশ্ববিদ্যালয় সকলেই দুর্দান্ত সাফল্যের সাথে ডিজিটালি পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন ছিল। তথ্যমতে, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, সমস্ত পরীক্ষার শতকরা পঁচাত্তর শতাংশ ডিজিটালি পরিচালিত হয়। আমাদের দেশেও ক্লাসটেস্ট ও অ্যাসাইন্টমেন্ট গতবছর হতে অনলাইনে নেওয়া হচ্ছে।
বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই কাগজে লেখার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের নিরীক্ষণের জন্য জুম বা গুগল শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করে। পরীক্ষা শেষ করার পরে, শিক্ষার্থীরা তাদের স্ক্রিপ্টগুলির শেষে একটি কোড বা আইডি লেখে এবং পরে স্ক্রিপ্টগুলি কার্যত স্ক্যান করে আপলোড করে জমা দেওয়ার জন্য তাদের সামান্য সময় বরাদ্দ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কুইজের জন্য শিক্ষার্থীদের একটি ভার্চুয়াল ফর্ম দেয়া হয় যা অনলাইনে উত্তর দেওয়া হয়। অনেকে আবার অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষা ও নিচ্ছে। বাংলাদেশে সম্ভবত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা শতভাগ পরীক্ষা অনলাইনে নিয়ে যথাসময়ে সেমিস্টার শেষ করেছে।
অনলাইন পরীক্ষার অনেকগুলো চ্যালেঞ্জও রয়েছে। স্বীকার না করে উপায় নেই, করোনভাইরাসের অপ্রত্যাশিত প্রভাব ছাত্রদের প্রাত্যহিক জীবনে পড়ছে। এই দাবিতে অবশ্যই কিছুটা পরীক্ষা গ্রহণে নমনীয় থাকতে হবে। তবে পরীক্ষার একটা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা বাঞ্চনীয়। দীর্ঘদিন প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে প্রশ্ন তৈরী করা এবং ছাত্রদের এটার সাথে ধাতস্থ করানো, দেশব্যাপী সমান ইন্টারনেট গতি ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা, সব ছাত্র সমান সুবিধা ভোগ করতে পারছে কিনা, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন – এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের দিকে থাকালে দেখব, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার কোন ব্যবস্থা বর্তমানে সংহত নাই। এক্ষেত্রে বিদ্যমান কাঠামোয় ও নিয়মে প্রচুর পরিবর্তন আনতে হবে এবং মূলধন বিনিয়োগ করতে হতে পারে।
আমার মনে আছে, বিদেশে আমার পিএইচডি প্রোগ্রামের বেশ কিছু কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল ওপেন বুক, যেটা আমাদের দেশে সেভাবে পরিচিত ও কার্যকর নয়। আমাদের সমস্যা হলো আমাদের পরীক্ষা স্ট্রাকচার অনেকটাই মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর। এটাকে অনলাইনে অন্তর্ভুক্তকরণ কঠিন। আবার হঠাৎ করে পরিবর্তন করাও সহজ না। তবে ধাপে ধাপে সে পদ্ধতির দিকে আমাদের এগুতে হবে। আমি মনে করি এটা একটা সুযোগ ছাত্রদের ধারাবাহিক ভাবে ওপেন বুক এঙাম প্রসেসের সাথে ধাতস্হ করা। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ের অনলাইন অলিম্পিয়াড সম্পন্ন হয়েছে সাফল্যজনক ভাবে। বই খুলেও আপনি এসব প্রশ্ন খুঁজে পাবেন না। অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করে; বিশ্লেষণী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে হবে। আশার কথা আমাদের সৃজনশীল প্রজন্ম কিছুটা হলেও এর সাথে অভ্যস্থ। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সততা ও নৈতিকতার প্রশ্নটা এসে যায় কারণ কোন প্রোক্টরের উপস্থিত ছাড়াই পরীক্ষা দিলে, একে অন্যের সাথে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করা তাদের পক্ষে সহজতর হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রার্থীদের কোনও শারীরিক প্রমাণীকরণ না থাকায় অন্যকেউ ছদ্মবেশ ধারণ করে পরীক্ষায় প্রঙি দিতে পারে।
তাই অনলাইন প্রোক্টরিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষার সময় জালিয়াতিমূলক কার্যকলাপ সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে অনেক ভালো ভালো প্রোক্টরিং সফটওয়্যার আছে যেগুলি দিয়ে সহজেই কাজ চালানো যায়। যেমন : টেস্ট ইনভাইট, হাইয়ার প্রো ও প্রোক্টর ট্র্যাক সহ ইত্যাদি। এ সফটওয়্যার গুলো পরীক্ষার জালিয়াতির সময় প্রার্থীর কম্পিউটার এবং ব্রাউজারটি লক হয়ে যাবে, যাতে পরীক্ষার্থী পরীক্ষার সময় নতুন ট্যাব, অ্যাপস, উইন্ডো ইত্যাদি খুলতে না পারে। কিন্তু অতিমূল্যের এ সফটওয়্যার গুলির লাইসেন্স প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কেনা অসম্ভব। এক্ষেত্রে সরকার বিডিরেন এর মাধ্যমে যেভাবে জুম সফটওয়্যারটি অনলাইন ক্লাস, মিটিং পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে বিনামূল্য দিয়েছিল এবারও একই রকম একটা প্রক্রিয়ায় যেতে পারে। আশাকরি ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসন ও সরকার সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনলাইন ক্লাসের মতো, অনলাইনে পরীক্ষা কার্যক্রম সফলতার সাথে সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম মসৃণভাবে চালু থাকবে। পরিশেষে সরকারকে সাধুবাদ জানাই, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায়।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।