বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণাকে প্রাধান্য দিতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ

২০২৩ সালে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ফরাসি অধ্যাপক অ্যান লুইলিয়ারকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর দেওয়ার জন্য নোবেল কমিটি ফোন করলে ক্লাসে ব্যস্ত থাকায় প্রথমে তিনি ফোন ধরেন নি। আবার ফোন করে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের খবর দিলে তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন ‘আমি ব্যস্ত, ক্লাস নিচ্ছিপরে কথা বলবো’ বলে ফোন রেখে দেন। অথচ তিনি আগে থেকে জানতেন নোবেল কমিটি তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য বিবেচনা করছে এবং সম্ভাব্য তালিকায় তাঁর নাম আছে। অধ্যাপক অ্যান লুইলিয়ার ছিলেন লুন্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইলেক্ট্রন গতিবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

বিষয়টি অবতারণার কারণ হলো পশ্চিমা বিশ্বের একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের চরিত্র বর্ণনা করা। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আরাধ্য বিষয় হলো নিবিড় গবেষণা ও শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞান বিতরণ করা। তারা গবেষণা ও ক্লাস নেওয়ার কারণে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যান। তাদের নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারের কারণে জ্ঞান বিজ্ঞানে পৃথিবী আজ এতো সমৃদ্ধ। আর সঠিক গবেষণা ও জ্ঞান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মানসম্পন্ন উচ্চতর ডিগ্রি। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো এক্ষেত্রে পিছিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা। সমপ্রতি এই চিত্রটিই উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২৩ সালের তথ্য নিয়ে তৈরি)। এতে বলা হয় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৫৬% শিক্ষকের উচ্চতর ডিগ্রি নেই। বাকি শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র ৩৮% পিএইচডি এবং ৬% এমফিল বা সমমানের ডিগ্রি রয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার উপর জোর দেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অধিকাংশ শিক্ষকের উচ্চতর ডিগ্রি না থাকায় গবেষণামূলক পড়াশোনা করানো তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে শুরুর পদেই পিএইচডি থাকার আবশ্যকতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউজিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে বিশেষ করে শুরুর পদে (প্রভাষক) পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পাস করার পরপরই অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। কিন্তু যথাযথ জ্ঞানের অভাবে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে হিমশিম খান বা ভালোভাবে পড়াতে পারেন না। যা দেশের উচ্চশিক্ষার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পিএইচডি ও স্বীকৃত জার্নালে গবেষণা প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদিও এসব বিষয়েও অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেকের চৌর্যবৃত্তির কারণে পদাবনতি হয়েছে। যা সত্যি দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে পিএইচডি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ২০২৩ সাল থেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষক নিয়োগে কেবল পিএইচডি নয়, পোস্টডক্টরাল গবেষণাও বাধ্যতামূলক। তাই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগে শুরুর পদেই অন্তত পিএইচডি থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত।

ইউজিসির সামপ্রতিক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০২৩ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫৩টি। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৮,২১,১৬৫ জন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ৫৩% এবং ছাত্রী ৪৭%। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২,২৫৭টি কলেজে শিক্ষার্থী পড়েন প্রায় ৩৪ লাখ।যা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মোট শিক্ষার্থীর ৭০.২০%

এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকি ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক আছেন ১৬,৮০৫ জন এবং শিক্ষার্থী প্রায় তিন লাখ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে ৫,৩৪১ জন অধ্যাপক, ,০৪৮ জন সহযোগী অধ্যাপক, ,০৯৭ জন সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক ২,২৮৮ জন। এ ছাড়া অন্যান্য পদে শিক্ষক আছেন ১,০৩১ জন। এরমধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৪টি বিভাগে শিক্ষক ছিলেন ২,৪১৮ জন (২০২৩ সালে)। যার মধ্যে ৯২৩ জন অধ্যাপক, ৪৫৯ জন সহযোগী অধ্যাপক, ৫২৯ জন সহকারী অধ্যাপক, ৩৮২ জন প্রভাষক এবং ১২৫ জন অন্যান্য পদে আছেন। এদিকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে মোট ৬,৪০৭ জন শিক্ষকের পিএইচডি এবং ১,০৩২ জনের এমফিল বা সমমানের ডিগ্রি আছে। অর্থাৎ উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক ৭,৪৩৯ জন, যা মোট শিক্ষকের ৪৪.২৭%। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পিএইচডি থাকার আবশ্যকতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিভিন্ন শিক্ষকেরা। তারা বলেন, যেহেতু ইউনিভার্সিটি, তাই তার আইন ও নিয়মকানুনও সেই মানেরই হতে হবে।

এদিকে একই প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের প্রায় ৮০% পিএইচডি ডিগ্রি নেই। শুধু পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে হিসাব করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪%। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দেশে ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১৭,৪৭৯ জন। পূর্ণকালীন শিক্ষক ১৩,১৬৯ জন। যার মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি আছে ২,০৭২ জনের। শতাংশের হিসাবে যা ১৫.৭৪%

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিএইচডিধারী শিক্ষক আছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০৮ জন। এ ছাড়া ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ২৮৩, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ২৬৪, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২২৮ ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে আছেন ২১৫ জন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন ৪,৩১০ জন। তাঁদের মধ্যে ১,৫৩১ জনের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। অর্থাৎ প্রায় ৩৬% খণ্ডকালীন শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩,৬০৩। অর্থাৎ মোট শিক্ষকের ২০.৬২% এর পিএইচডি ডিগ্রি আছে।

বহু আগে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর পাস ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। এখন সেখানে শিক্ষক নিয়োগে কেবল পিএইচডিই যথেষ্ট নয়, পোস্টডক্টরাল গবেষণাও থাকতে হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের অনেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে হলে পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল গবেষণা থাকতে হয়। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে শুরুর দিকে পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল গবেষণা থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি এখন বিশ্বজুড়েই এক অপরিহার্য যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত। ভারতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে পিএইচডিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি দেশটির ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন পিএইচডি বাধ্যতামূলক করার রেগুলেশনও জারি করে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পিএইচডির মাধ্যমে শিক্ষকেরা কেবল গবেষণায় নয়, পাঠদানে ও বিশ্লেষণমূলক চিন্তায়ও দক্ষতা অর্জন করেন। এ ডিগ্রি শিক্ষকের পেশাগত উৎকর্ষ, গবেষণার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কার্যকর নির্দেশনা প্রদানে সহায়ক। তারা বলেন, দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার ওপর জোর দেওয়ার কথা থাকলেও ‘যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতির’ কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আর গবেষণায় জোর দেওয়ার প্রশ্নে সবার আগে আসে পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়। তাদের অভিমত, পেশাগত দক্ষতা অর্জন এবং গবেষণা খাতে উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়োগপদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতকোত্তর কলেজগুলোর মূল পার্থক্য হলোবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান উৎপাদন করবেন ও সমৃদ্ধ হবেন। কিন্তু কলেজগুলো সেটি করবে না। আর গবেষণা করতে হলে শিক্ষকদের যথাযথ ডিগ্রি থাকা আবশ্যক। এর ব্যত্যয় হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধুমাত্র গতানুগতিক ডিগ্রিধারী মানুষ বের হবে। যা জাতি ও রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণে আসবে না এবং এটি আমাদের কাম্য হতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সময় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির বাইরেও পিএইচডি এমফিল এমএস ইত্যাদি ডিগ্রিধারী গ্রেজুয়েটদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আর যত দ্রুত এর বাস্তবায়ন করা হবে তত দ্রুত দেশ এগিয়ে যাবে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির শিখরে।

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের গান তারুণ্যের জয়গান
পরবর্তী নিবন্ধসূচনা যেখানে পতনও সেখানেই : কিন্তু কেন?