বিশ্বনবী এসেছিলেন প্রতিটি দিনের জন্য

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ, মানবতার মুক্তির দিশারী, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আ’লামিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি শুধুমাত্র একটি বিশেষ দিনের জন্য আসেননি কিংবা একটি মুহূর্তের জন্যও আসেননি। তিনি এসেছিলেন পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে আলোর পথ দেখানোর জন্য। তিনি এসেছিলেন না কোনো গোষ্ঠীর জন্যে, না কোনো গোত্রের জন্যেউনি সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতের জন্য এসেছিলেন আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও নবী হিসেবে, ‘(হে নবী) আমি তো তোমাকে সৃষ্টিকূলের জন্যে রহমত বানিয়েই পাঠিয়েছি’সূরা আম্বিয়া১০৭। বিশ্বনবী তাঁর জন্মদিন পালন করার জন্য দুনিয়ার মানুষদেরকে কোন বার্তা দেননি। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত জীবন বিধান সহকারে দুনিয়ার বুকে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে এসেছিলেন। ‘তুমি বল, হে আমার রবতুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যাও এবং সত্যের সাথেই বের কর এবং তোমার কাছ থেকে আমার জন্যে একটি সাহায্যকারী রাষ্ট্রশক্তি প্রদান কর’সূরা বনী ইসরাইল৮০।

আর বিশ্বনবী মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর জন্যে একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন এবং ১০ বছর শান্তিপূর্ণভাবে মদিনা শাসন করেছেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রটিতে ৪টি ধর্মের সহাবস্থান ছিল। সব মত ও পথের মানুষেরা মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য আসতেন এবং তা তিনি সন্তোষজনকভাবে সমাধান দিয়ে দিতেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠা যদি এতই সহজ হত তাহলে উহুদের ময়দানে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর দানদান মোবারক শহীদ হতেন না, তায়েফের ময়দানে দুষ্ট বালকদের দ্বারা পাথরের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতেন না, অসংখ্য যুদ্ধে নিজে সেনাপতি হয়ে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিতেন না। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজটি ভয়াবহ কন্টকাকীর্ণ, এটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যুগে যুগে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)ও সাহাবীগণ, তাবেঈ ও তাবেতাবেঈনরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, ‘অনেক নবী (আল্লাহর পথে) যুদ্ধ করেছে, তাঁর সাথে (আরও যুদ্ধ করেছে) অনেক সাধক ব্যক্তি, আল্লাহর পথে তাদের উপর যত বিপদমসিবত এসেছে তাতে তারা হতাশ হয়ে পড়েননি, তারা দুর্বলও হয়নি, মাথা নত করেননি, আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন’সূরা আলেইমরান১৪৬। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, আমরা আজ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ বাদ দিয়ে ইসলামকে একটি আনন্দ ও উৎসবমূখর ধর্মে পরিণত করেছি। কষ্টের পথে না গিয়ে আরাম আয়াশের মধ্যে ধর্ম চর্চা আমাদের এখন মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছেযেটি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর জিন্দেগীতে ছিল না, সাহাবীদের জিন্দেগীতে ছিল না, তাবেঈ, তাবেতাবেঈনদের জিন্দেগীতে ছিল না এবং এরকম উৎসবের খবর আল্লাহর কোরআনের একটি আয়াতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং এর স্বপক্ষে কোন সহীহ হাদীস ও নেই, যা আছে তা বানোয়াট ও জাল হাদিস। ইসলাম ধর্মকে বিশেষ দিনে উৎসব পালন করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যে মিশন ও ভিশন নিয়ে দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তথা ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠাএটার মেহনত করা অনেকাংশে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। অথচ আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশনা, ‘তোমরা এই বিধানকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না’সূরা আশ শূরা১৩। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এই উৎসব পালিত হয় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিন হিসেবে কিন্তু একই দিন সরাসরি সরেজমিনে মক্কা ও মদিনায় গিয়ে তদন্ত করে আসলে দেখা যাবেসেখানে এদিনে নেই কোন উৎসব, নেই কোন আমেজ। অথচ এদিনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওফাত হয়েছেন। সেজন্যে তাঁর জীবনী, সীরত, তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না। এদিনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছিলেন। যে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন, সে শহরেই তো তাঁর জন্মদিনের কোন উৎসবআমেজ দেখা যায় না। সেখানকার প্রবাসী অনেক বাংলাদেশীর সাথে আমার কথা হয়েছে মক্কামদিনাবাসীরা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের মতন এ ধরনের উৎসব করেন না। অথচ আমরা অতি উৎসাহী হয়ে এই অগ্রহণযোগ্য কাজ করতে দ্বিধাবোধ করি নাযেটা শরিয়াহ পরিপন্থী। দেখা যায়, এই উৎসব চলাকালে পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজের আজান হচ্ছে, ফরজ নামাজ হচ্ছে এবং নামাজীদের মনোযোগের যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে সেদিকে উৎসব পালনকারীরা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে হাই ভলিউম সাউন্ড বাজিয়ে নাতে রাসূল গেয়ে যাচ্ছেন। আমরা যদি এতই নবীর আশেকে রাসূল (সাঃ) হই, তাহলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের মুহূর্তে যে বার্তাটি বিশ্ববাসীর কাছে দিয়ে গেছেন, ‘ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি সালাত সালাত’সেই সালাতের প্রতি আমাদের অতি উৎসাহী আশেকে রাসূলরা কেনো খেয়াল করেন না? সত্যি বলতে কী, নবীর প্রতি যদি দরদ থাকে তাহলে নবীর ভিশন ও মিশনের প্রতি যত্নবান হতে হবে। এমনকি এই উৎসবের দিনে দেখা যায় অনেক আশেকে রাসূল ফরজ নামাজ তরক করে থাকেন, তাহলে এধরনের উৎসব আমাদের জন্য কি বার্তা বয়ে আনে? মক্কা ও মদিনা শহর যেখান থেকে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন শুরু, সেখানে এধরনের আলোকসজ্জা করে, মেজবান করে উৎসব করে পালন করা হয় না। বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে কেন এই উৎসবের আয়োজন? মক্কামদিনার প্রতিটি বালুকনায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের রক্তের দাগ এখনো লেগে আছে, দিনের পর দিন রাতের পর রাত না খেয়ে বিশ্রাম না নিয়ে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার মেহনতে যারা কালের সাক্ষী হয়ে আছেন তাদেরকে অনুসরণ করাই তো আমাদের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অথচ সেই উদ্দেশ্য হাসিলের প্রচেষ্টা না করে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের কাছে একটি উৎসবের ধর্ম হিসেবে পরিচিতি করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছেযেটা নিতান্ত দুঃখজনক। এই কোরান নাযিল হয়েছে প্রিয় নবীর উপর। যার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে সমগ্র মানবজাতির উপর। আর সেই কথাটিই আল্লাহতায়ালা বলেছেন এভাবেই, ‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তার জন্য বাঁচার সামগ্রী সংকুচিত হয়ে যাবে, তাকে আমি কেয়ামতের দিন অন্ধ বানিয়ে হাজির করবো। সে (নিজেকে এভাবে দেখার পর) বলবে, ‘হে আমার মালিক তুমি আমাকে কেন অন্ধ বানিয়ে উঠালে? দুনিয়াতে তো আমি চক্ষুষ্মান ব্যক্তি ছিলাম।

তিনি বলবেন, তুমি এমনিই অন্ধ ছিলে, আমার আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলেছিলে, এভাবে আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হবে’সূরা ত্বাহা১২৪১২৬। ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমার রাসূল (সাঃ) পৃথিবীর জন্য রোল মডেল হয়ে থাকবেন। ‘অবশ্যই আমি সত্য দ্বীনের সাথে তোমার উপর এই গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে করে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তোমাকে যা দেখিয়েছেন তার আলোকে তুমি মানুষের মাঝে বিচার মীমাংসা করতে পার’সূরা আন নিসা১০৫। দ্বীন প্রতিষ্ঠা ফুলশয্যার বিছানা নয়এটি অনেক ত্যাগতিতিক্ষার কঠিন ফসল।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীরা জিন্দেগীভর এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য গাছের বাকল খেয়ে দিনাতিপাত করেছেন। তবুও ইক্বামতের দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হননি। মক্কার শে‘বে আবি তালিবে তিন বছরের অধিক সময় প্রিয় রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীরা গাছের পাতা খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন কিন্তু বাতিলের সামনে মাথানত করেননি। আর সেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার দিনটিকে আমরা একটা হাস্যকর উৎসবে পরিণত করেছি। আমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর রেখে যাওয়া আদর্শকে দুনিয়ার জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্যে নির্ঘুম একটি রাত অতিবাহিত করেছি? শেষ রাতে উঠে দ্বীন কায়েমের জন্যে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে নোনাজারি করেছি? আশ্রয় চেয়েছি? সাহায্য চেয়েছি? অধিকাংশ উত্তরে আসবে না। অথচ উৎসব আমেজের বেলায় আমরা শতভাগ পাশ। পরিশেষে আসুন, দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ ও চরিত্রকে প্রাধান্য দিই। ‘নিঃসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছো’সূরা আল কালাম০৪।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ‘সুপারফুড’
পরবর্তী নিবন্ধশিশুর পরিপূরক খাবার কী? কীভাবে খাওয়াবেন