বিল্টুদের ওয়াশিংমেশিন

দীনা মরিয়ম | বুধবার , ২ জুলাই, ২০২৫ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

এই এলাকায় নতুন এসেছে টুকটুকরা। বেইলী রোডের একটা গলিতে আটতলা বাড়ি। এ মাসের শুরুতেই টুকটুকরা এর দো’তলায় উঠেছে। বাসাটা বেশ সুন্দর কিন্তু টুকটুকের একদমই পছন্দ হয়নি। আগের বাসাটা অনেক পছন্দ ছিল । আপির স্কুল কোচিং দূরে হওয়ায় বাসাটা চেঞ্জ করতে হয়েছে। নতুন বাসা থেকে আপি একা একা কোচিংয়ে যেতে পারে। আগের বাসায় যখন ছিল প্রতিদিন আম্মু আপিকে কোচিংয়ে নিয়ে যেতো, কোচিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকতো।আপির সাথে টুকটুকও কোচিংয়ে যেতো আর বাইরে বসে থাকতো আম্মুর সাথে। কত আন্টিরা আসতো, গল্প করতো, ওকে আদর করতো। প্রতিদিন কোচিং থেকে যাওয়ার পথে আকাবা স্টোর থেকে খাওয়ার জন্য অনেক কিছু কিনতো। খুব মজা হতো, এখন আর সেই মজা নেই। এখানে টুকটুকের খেলার মতো কেউ নেই! ওর বাবা খুলনায় চাকরি করে, সেখানেই থাকে; শুধু শুক্রবার ছুটিতে আসে।তাই টুকটুক আর আপিকে আম্মুর সাথেই থাকতে হয়। আপি স্কুলে চলে গেলে বাসায় শুধু টুকটুকি আর আম্মু। আম্মু সারাক্ষণই কোন না কোন কাজে ব্যাস্ত তার সাথে তো কথাই বলা যায় না। টুকটুক একাই খেলা করে, কখনো টিভি দেখে,কখনো ব্যালকনিতে গিয়ে বসে থাকে। ব্যালকনি থেকে সামনেই যে বাড়িটা, সেখানে ওরই মতো একটা বাচ্চা থাকে।টুকটুকের সাথে ক’দিন হলো পরিচয় হয়েছেওর নাম বিল্টু। জানালা দিয়ে ওর সাথে কথা বলে। এ ক’দিনেই বিল্টুদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে টুকটুক। এই যেমন বিল্টু এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, ওর বাবা নেই, ওর মা একটা অফিসে কাজ করে, বিল্টুদের একটা কাজের বুয়াখালা আছে, ও সারাদিন সেই খালার সাথেই থাকে। বিল্টুর অনেক খেলনা আছে কিন্তু ওর সাথে খেলার কেউ নেই। কাজের খালা সারাদিন কাজ করে আর বিল্টু তার পেছন পেছন ঘোরে।টুকটুুক বিল্টুর সেই কাজের খালাকে দেখেছে। বিল্টুদের বাড়ির পেছনের ব্যালকনিতে ওদের ব্যালকনিতে একটা সিঙ্ক বসানো আছে , দিনের বেশিরভাগ সময়ই সেই কাজের খালা ওখানেই বসে কাজ করে।সেখানে একটা বড় চারকোণা বাক্সের মতো কিছু একটা আছে, খালা সেই বাক্স নিয়েও কিছু একটা করে। সেখানে কাজ করার সময় অনেক জোরে জোরে শব্দ হয়। টুকটুকদের বাসা থেকে ভীষণ জোরে সেই আওয়ার শোনা যায়। টুকটুকের ভয় লাগে তাই সে হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরে থাকে। সে বিল্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলো ওই বাক্সটায় কি আছে, অমন শব্দ বের হয় কি করে? বিল্টু বলেছে ওটা নাকি ওয়াশিংমেশিন। টুকটুকদের ওয়াশিংমেশিন নেই তবে সে চেনে । নানুর বাসায় আছে কিন্তু সেটা তো এমন ভয়ংকর শব্দ করে না। টুকটুকের মনে হলো বিল্টু ঠিক কথা বলেনি, সে হয়তো জানেই না ওটা কী। ওটার মধ্যে নিশ্চয়ই রাক্ষস থাকে, সেই রাক্ষসটাই ক্ষুধা পেলে ওরকম শব্দ করে। বিল্টুকে বিষয়টা জানানো দরকার কিন্তু কয়েকদিন হলো ওর সাথে দেখাই হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে টুকটুকের নানাভাই এসেছেন হার্টের ডাক্তার দেখানোর জন্য। সে এখন নানাভাইকে নিয়ে ব্যাস্ত। তাঁর হার্টের অসুখ আছে। তার উপর ভারতপাকিস্তান যুদ্ধ লাগতে পারে জানার পর থেকে তিনি খুব টেনশনে আছেন তাই অসুখটা বেড়ে। নানাভাইয়ের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি টেনশন করছেন। নানাভাইয়ের মাথায় চুল নেই, থাকলে এই টেনশনে সব চুল ঝরে যেতো । টুকটুকের ধারণা চুল পড়তে পারছে না বলেই হয়তো তাঁর হার্টের উপর চাপটা বেশি পড়ছে। এই সময় নানাভাইকে রাক্ষসের বাক্সটার কথা বলা ঠিক হবে না। এই টেনশন তার নিজের, নিজেকেই ম্যানেজ করতে হবে। সবার আগে বিল্টুকে বিষয়টা জানাতে হবে। ওরসাথে টুকটুক ব্যালকনির দিকে যাচ্ছিলো, তখনই সেই বিকট আওয়াজ শুরু হলো। টুকটুক দুইহাতে কান চেপে ধরলো।

তার মাঝেই নানাভাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলো,‘যুদ্ধ, শুরু হয়ে গেছে।’ টুকটুক দৌড়ে নানাভাইয়ের কাছে গেলো, তিনি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসেই চেঁচাচ্ছেন। আম্মুও ছুটে এসেছেন,‘কি হইছে আব্বা? কিসের যুদ্ধ? স্বপ্ন দেখছেন নাকি?’ নানাভাই আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আরে কোথাও যুদ্ধ লেগে গেছে। কোন খবরই তো রাখিস না। ওই শোন বিমানের আওয়াজ।’ আম্মু বললেন,‘আব্বা, এরকম কিছুই হয়নি, পাশের বাসার ওয়াশিংমেশিনের আওয়াজ শুনছেন। আপনার আরেকটু রেস্ট দরকার, আপনি শুয়ে পড়েন।’ নানাভাই একটু স্বাভাবিক হলেন, ‘মানে? ওয়াশিংমেশিনের এইরকম বিকট আওয়াজ হয় নাকি?’ আম্মু বললেন, ‘সাধারণত হয় না কিন্তু ওটা অনেক পুরোনো মেশিন, কিছু একটা নষ্ট হয়েছে ভেতরে তাই ওরকম আওয়াজ করে।’ নানাভাই একটু স্বস্তি পেলেন, ‘ও তাই বল, আমি তো ভাবলাম . . . কি ভয়াবহ আওয়াজ রে বাবা!’ নানাভাইয়ের সাথে সাথে টুকটুকও স্বস্তি পেলো তারমানে বাক্সটার মধ্যে রাক্ষস নেই। বিল্টু ঠিকই বলেছিলো, ওটা ওয়াশিংমেশিনই ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখুকুর পুতুল
পরবর্তী নিবন্ধমিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি: গ্রিসের অধিবাসীরা বলতো দুধের পথ