বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সার্কাস

বাসুদেব খাস্তগীর | বুধবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

সার্কাস একটি ঐতিহ্যবাহী বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু আমাদের দেশে বিনোদনের এ মাধ্যমটি এখন শুধু ঐতিহ্যের বিষয় হিসাবেই কাগজেকলমেই আছে। মাঝে মধ্যে দেশের গ্রামীণ মেলায় যেটুকু দেখা মেলে তাও হয়তো ভবিষ্যতে আর থাকবে না। জনপ্রিয় এ মাধ্যমের প্রদর্শনী দেখতে একসময় সার্কাসে ভিড় লেগেই থাকত। সিনেমা দেখতে মানুষ একসময় যেভাবে সিনেমা হলে ভিড় করতো, ঠিক তেমনি সার্কাস দেখার জন্যও গ্রামাঞ্চলে মানুষের ভিড় ছিল কল্পনাতীত। যখন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেভাবে প্রসারিত হয়নি তখনও গ্রামাঞ্চলে সার্কাসের প্রদর্শনী ছিল সাধারণ জনগণের বিনোদন পাবার জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এখন সেই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখারও এক ক্রান্তিকাল চলছে। সার্কাসের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণের খোঁজ নিয়ে দেখা যায় প্রাচীন রোমেই এর উৎপত্তি হয়। সেখানে সার্কাস ছিল ছাদবিহীন একটি আখড়া যেখানে ঘোড়দৌড় এবং অন্যান্য প্রদর্শনী হতো। এখানে অন্যান্য প্রদর্শনী মানে শারীরিক কসরতের প্রদর্শনী, যা ধীরে ধীরে পৃথিবীর নানা দেশে বিস্তৃতি লাভ করে এবং ছড়িয়ে যায় দেশ হতে দেশান্তরে। আমাদের দেশেও তার ঢেউ এসে লেগেছিল বহু বছর আগে এবং এটি ধীরে ধীরে আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালি সংস্কৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের মধ্যে সার্কাসও হয়ে উঠেছিল অন্যতম। বিশ্বের পরিবর্তনশীল যুগে প্রযুক্তির ডামাডোলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবার দলের সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশের সার্কাসও। সার্কাস নামের বাঙালির ঐতিহ্যের এ বিশেষ প্রতিষ্ঠানটির কথা আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছে শুধু একটি নাম সর্বস্ব বিষয়ের মত মনে হতে পারে। সচক্ষে সার্কাস দেখে আনন্দ উপভোগ করেছেন এই সময়ে এমন ছেলেমেয়েদের দেখা খুব কমই মিলবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সার্কাসের নানা শারীরিক যে কসরত আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই দেখছেন এবং তা বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধিও করছেন। বাস্তবতা হচ্ছে এ শিল্পটি গ্রামের পথে প্রান্তরে একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। কালের বিবর্তনে অনেক হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে যোগ হচ্ছে সার্কাস। আমরা যখন স্কুলে পড়াশুনা পড়তাম তখন দেখতাম আশপাশের কোনো মাঠে কিংবা কোনো স্কুলের মাঠে মাসব্যাপী সার্কাসের প্রদর্শনী হতো। সিনেমার মত নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে সার্কাসের প্রদর্শনীর জন্য সারা এলাকা জুড়ে মাইকিং করা হতো। মাইকিং করার সময় সার্কাসের নানা খেলার এমনভাবে বর্ণনা করা হতো যাতে দর্শকরা আগ্রহী হয়ে সার্কাস দেখতে আসেন। এখন এসব এ প্রজন্মের কাছে অনেকটা গল্পের কাহিনির মতই শোনায়। বাঙালিদের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আছে, যা একান্ত আমাদের। পৃথিবীর অনেক জাতির মধ্যে আমাদের এই ঐতিহ্যের বিষয়গুলোর তেমনভাবে দেখা মেলে না। সার্কাস পৃথিবীর অনেক দেশে আছে বটে, কিন্তু আমাদের বাঙালিদের সার্কাস আমাদের গ্রাম বাংলাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো। আগে বিভিন্ন গ্রামীণ মেলায় সার্কাস একটি বিশেষ স্থান দখন করে থাকত। এখন সেই মেলায় আর তেমনটি সার্কাসের দেখা মেলে না। সার্কাসের জন্য একটি বড় আকারের জায়গার প্রয়োজন হয়। এখন যে সমস্ত জায়গায় মেলা হয় সেখানে অতবড় জায়গা দিতে মেলা কর্তৃপক্ষ তেমন উৎসাহী নন। আর বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনার এ যুগে সব জায়গায় মেলার বড় পরিসরের জায়গা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে । সার্কাস হল মূলত একটি শারীরিক কৌশল প্রদর্শনের ব্যাপার। এক ধরনের হাসি ঠাট্টায় মানুষকে সার্কাসের মাধ্যমে বিনোদন দেয়া হতো। মানুষের জীবনটা আসলেই হাসিকান্নার নানা ঘটনায় ভরপুর। জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাতে বিনোদনেরও দরকার আছে। সার্কাস সেই বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। কালের বিবর্তনে সেই বিনোদনের মাধ্যম ধীরে ধীরে বিপন্ন ঐতিহ্যের কাতারে সামিল হচ্ছে। শারীরিক কসরত, এক ধরনের মূখাভিনয় ও নানা ধরনের কৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সার্কাসে এ বিনোদন দেয়া হতো। এই শারীরিক কসরত, বিশেষ কলাকৌশল এবং নানান দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সার্কাসের শারীরিক কসরতের কাজগুলো আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হয়। এখানে অনেক শারীরিক কসরত আছে যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সামান্য এদিক সেদিক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। সার্কাসে সে রকম অনেক দুর্ঘটনার খবর কিন্তু সংবাদ হয়ে আসতো কিংবা গ্রাম বাংলায় যখন সার্কাসের প্রদর্শনী হতো সে রকম দুর্ঘটনা অনেকেই স্বচক্ষেও দেখেছেন। সার্কাসে মানুষের শারীরিক কসরতের বিষয়গুলো ছাড়াও বিভিন্ন প্রশিক্ষিত প্রাণীর খেলাও দেখানো হতো। শারীরিক কসরত, সাহস এবং কলাকৌশলের ব্যাপারটা সার্কাসের মূখ্য বিষয়। সার্কাসের বিষয়গুলো দেখলে মনে এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগে। মনে মনে মানুষ ভাবে ‘সত্যি এটা কি সম্ভব?’ এটা জাদুকরি কোনো বিষয় নয়, নিতান্তই চর্চা ও কৌশলদীপ্ত একটি বিষয়। সার্কাসের প্রদর্শনীর জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থাকতো না, এটি ছিল এক ধরনের ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কিছুদিন বিনোদন দেয়ার পর অন্য জায়গায় চলে যেত সার্কাস দল। এটি একটি দলীয় কাজ। সার্কাসের একেকটি দলে প্রায় শতাধিক লোক জড়িত থাকে। নির্দিষ্ট কোনো মাঠ বা শুষ্ক মৌসুমে খালি জমিতে তাঁবু দিয়ে এই সার্কাস প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হতো। সার্কাসের বড় তাঁবুর নিচে একটি বৃত্তাকার অঙ্গনে এসব প্রদর্শনী পরিবেশিত হতো, যেখানে দর্শকদের চারপাশ থেকে পরিবেশনা দেখার ব্যবস্থা থাকত। দূরের দর্শকের জন্য সামনের সারির দর্শকদের তুলনায় উঁচু আসন তৈরি করা হতো যাতে দূর থেকেও প্রদর্শনী দেখা যায়। বাংলাদেশে একটি সার্কাস মালিক সমিতি রয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে অনেক তালিকাভুক্ত সার্কাস দল রয়েছে প্রায় পঁচিশটি। এর বাইরেও প্রায় শতাধিক সার্কাস দল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে প্রথম সার্কাস দলের নাম ‘দি লায়ন সার্কাস’। স্বাধীনতার পর দি সোনার বাংলা সার্কাস, দি রাজমনি সার্কাস, দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস, দি বুলবুল সার্কাস, দি নিউ স্টার সার্কাস, দি ন্যাশনাল সার্কাস, নিউ সবুজ বাংলা সার্কাস হচ্ছে গ্রামবাংলায় দাপিয়ে বেড়ানো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সার্কাস দলের নাম। সার্কাসে শিল্পীদের পরিবেশনা, প্রাণীদের অংশগ্রহণসহ এক ধরনের যে বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি হয় তার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্ত করে কিছুটা নির্মল আনন্দ দেয়া এবং সেইসাথে মানুষকে চিত্তাকর্ষক কিছুটা অভিজ্ঞতা প্রদান করা। এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারও এখানে আছে। এটাকে পেশা হিসাবে নেবার এখন খুব কঠিন সময়। সার্কাসের এই দুর্দিনে এই পেশার লোকেরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য পেশাকে বেচে নিয়েছে অনেক আগেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যমটি এখন হারিয়ে যাবার দলে। বাংলাদেশে সার্কাসের যে একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও ইতিহাস ছিল তা অনেকটাই এখন ম্লান। বাস্তবতা হচ্ছে সার্কাস এখন একটি কঠিন সময় পার করছে। যাত্রা শিল্পের মত সার্কাসের শিল্পীরা নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নিপতিত। এ কারণে এ পেশা একটি বিলুপ্তপ্রায় পেশা হিসাবে পরিণত হয়েছে। সার্কাস শিল্পটি দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশের স্বার্থে ধরে রাখা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ