বিলীন হওয়ার পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য-অনুষঙ্গ

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | শুক্রবার , ১৬ মে, ২০২৫ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার জীবনযাপনে নিয়ে এসেছে নতুন গতি। জীবন বদলে দেওয়ার এই জাদুর কাঠির সঙ্গে হারিয়ে গেছে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা অনেক জিনিসপত্রও। অপ্রিয় হলেও সত্য, নতুন প্রজন্মের কিশোরকিশোরীরা তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের বহুমাত্রিক ব্যবহারের কারণে ভুলে যেতে বসেছে আবহমান কালের বাংলার ঐতিহ্যঅনুষঙ্গ। সত্তর বা নব্বই দশকে যে যন্ত্রগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে সবই কালের গর্ভে বিলীন।

প্রসঙ্গত, টেলিফোন আবিষ্কারের পূর্বে চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এমন কী টেলিফোন আসার পরও চিঠি আদানপ্রদান কমে যায়নি। যান্ত্রিকতার যুগে অনেকেই এখন হলুদ ডাকটিকিটে মোড়া চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে চিঠি হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। এখন আর ডাকবাক্স বা খাকি পোশাক পরিহিত ডাকপিয়নের সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শোনা যায় না কোথাও।

সারাদেশে বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে একসময়ের নিত্যকার প্রয়োজনীয় যন্ত্র হারিকেন হারিয়ে যাওয়ার তালিকায়। তবে এখনো কিছু গ্রামাঞ্চলে হারিকেনের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু একসময় ছিল যখন বিকেল হতেই বাড়ির মেয়েরা হারিকেনের কাচ মুছে চিমনীতে কেরোসিন তেল ঢেলে সন্ধ্যার আঁধার ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতো। সূর্য ডুবতেই বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে উঠতো হারিকেন। একটা গ্রামকে দূর থেকে দেখলে তখন মনে হতো মাটির বুকে আকাশের তারা নেমে এসেছে। অনেকেই হারিকেন জ্বেলে বসে যেতো পুঁথিপাঠের আসরে। হাজার বছর ধরেচলচ্চিত্রে এমন কিছু দৃশ্য আছে যা সেই সময়কার জীবনের চালচিত্র তুলে ধরে। দেশে বিদ্যুতের সংযোগ, সৌরচুল্লির ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় হারিকেন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।

গানপাগল বাঙালির গান শোনার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সত্তরের দশকে ক্যাসেটের আবির্ভাব ছিল সংগীতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বলা যায়, ১৯৮০এর দশকে রাজত্ব করেছে ক্যাসেট। গ্রাম কী শহর সর্বত্রই ছিল ক্যাসেটের জয়জয়কার। বাংলা সিনেমার আধুনিক গান কিংবা পল্লীগীতি, নজরুল সংগীত অথবা ওপার বাংলার জনপ্রিয় গান সবই বেজে উঠতো বাড়িতে বাড়িতে ক্যাসেটের ভেতর।

একটি ক্যাসেটের ভেতর লম্বা সরু সেলুলয়েডের ফিতা থাকত। এ ক্যাসেট দিয়ে গান রেকর্ড এবং গান বাজানো সবই করা যেত। ১৯৭০এর দশকে প্রথম বাজারে আসে ভিসিআর। ভিসিআর যন্ত্রটি মূলত চলচ্চিত্র দেখার কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ঘরে বসে চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এই যন্ত্রটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। যন্ত্রটির ভেতরে ক্যাসেট ঢোকালেই ঢাকাই ছবির প্রিয় মুখ কিংবা হলিউড, বলিউডের পছন্দের সিনেমাগুলো চলতে শুরু করতো। গ্রামাঞ্চলে চাঁদা তুলে ভিসিআরে ছবি দেখা হতো। কিন্তু ঘরে ঘরে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের সুবিধা আর ইউটিউব ব্যবহারের ফলে ভিসিআর হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেডিও বাংলাদেশবেতার ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পুরান ঢাকা থেকে সর্বপ্রথম সম্প্রচার শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে থেকেই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা প্রচারিত হয়। টেলিভিশন আসার পূর্বে রেডিও ছিল সংবাদ জানার এবং বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধের সকল সংবাদ রেডিওর মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো হতো। টেলিভিশন আসার পরও অনেক বাড়িতে রেডিও যন্ত্রটি বাজতে শোনা যেত। গ্রামের দোকানগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা চলতো রেডিও। কিন্তু ক্রমেই টেলিভিশন সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার কারণে রেডিও যন্ত্রটি হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। তবে রেডিও এফএম অনেকের ফোনেই যুক্ত আছে।

১৮৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল ঢাকার ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ সেদিন থেকেই প্রথম টেলিফোন ব্যবহার শুরু করেন ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহ। টেলিফোনের ঐতিহ্য বহাল ছিল কয়েক বছর আগেও। তবে সে ঐতিহ্যে অনেকটাই বিলীয়মান মোবাইল ফোনের ব্যাপক জনপ্রিয়তায়।

পালকি মানুষ বহন করার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন। এই বাহনে একজন বা দুজন যাত্রী নিয়ে ২, ৪ বা ৮ জন বাহক এটিকে কাঁধে তুলে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে ধনী শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বরকনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে পশুচালিত যানবাহন এবং পরবর্তীতে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার ক্রমশ কমতে থাকে। ১৯৩০এর দশকে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন শুরু হয়, ফলশ্রুতিতে পালকির ব্যবহার একেবারে উঠে যায়। তবে গ্রামাঞ্চলে ৮০র দশকেও এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে কোনো নারী সদস্য বা বিয়ের কনেকে বহন করার জন্য পালকির ব্যবহার ছিল। তবে ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যানের চলাচল এবং প্যাডেল চালিত রিক্সা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন।

ইসামীর ফুতুহউসসলাতীনগ্রন্থ থেকে জানা যায়, চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ভারতে চরকার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বাংলায় এ যন্ত্রের প্রচলন ঘটে চৌদ্দ শতকের শেষ দিকে। ১৬ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তো বার্বোসা লিখেছিলেন, ‘বাংলার লোকজন চরকায় সুতা কেটে পোশাক তৈরি করতো। পুরুষেরা তৈরি করতো চরকাযন্ত্র আর মেয়েরা সে যন্ত্রে সুতা কাটতো। মূলত মোটা সুতিবস্ত্র বুননের জন্য যে সুতোর দরকার হতো তা চরকায় কাটা হতো।’ কাপড় বোনার ইলেকট্রনিক মেশিন আসার পর থেকে চরকা হারিয়ে যায় আস্তে আস্তে। তবে প্রাচীনকালের ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে এখনো কিছু বাড়িতে দেখা মিলবে সুতো বোনার এই যন্ত্রটির।

গ্রামবাংলার এক সময়ের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম গরুর গাড়ি। নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটছে, হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের এই ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি, যা আজ বিলুপ্তির পথে।গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়িয়াল। সেই চালককে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিয়া ন্যাং মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’ এইরকম যুগান্তকারী সব ভাওয়াইয়া গান। দুই যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেত না। বরপক্ষের লোকজন ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ি সাজিয়ে বরযাত্রী যেত। সে সময় যেসব পরিবারে গরুর গাড়ি ছিল, তাদের কদর ছিল বেশি। গরুর গাড়ির দুই চাকা একটি দণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই চাকা সাধারণত বড় ও কাঠের হয়। গাড়ির সামনের দিকে থাকে একটি জোয়াল, যা গরুর ঘাড়ে রাখা হয়। দুটি গরু মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। চালক গাড়ির সামনে বসে। তার পেছনে বসে যাত্রীরা। সবার পেছনে রাখা হয় মালপত্র। গরুর গাড়িতে যাত্রীদের বসার জন্য পাটাতন রাখা হয়। পাটাতন বানানো হয় বাঁশ বা কাঠ দিয়ে। এ ছাড়া যাত্রীদের রোদবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে গাড়ির ওপরে বসানো হয়। বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।

লেখক: গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনস্টাইনের দেশে
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পী শাহজাহানের একক গজল পরিবেশন