‘বিলীন’ হয়ে যাওয়া লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) নতুন করে যাত্রা শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগকে ব্যবহার করে ‘বিলীন’ হয়ে যাওয়া ডব্লিউটিসি’র আজ (মঙ্গলবার) জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠাতব্য এই সভা নিয়ে জাহাজ মালিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। জাহাজ মালিকদের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ সংগঠনটির যাত্রা শুরুকে ‘ডব্লিউটিসি’র ফান্ডে থাকা কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের নয়া উদ্যোগ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য নতুন উদ্যোগ নেয়া নেতৃবৃন্দ বলেছেন, লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের স্বার্থেই ডব্লিউটিসি’কে কার্যকর করার এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
অবশ্য চট্টগ্রামের একাধিক জাহাজ মালিক গতকাল দৈনিক আজাদীকে সভায় যোগদান থেকে বিরত থাকার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক দলাদলিতে আগে যেমন এই সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সামনেও তার লক্ষণ স্পষ্ট। সকল জাহাজ মালিকদের সমন্বয়ে সুষ্ঠুভাবে একটি সেল গঠনের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হলে জাহাজ মালিকেরা রক্ষা পাবে। অবশ্য, কয়েকজন জাহাজ মালিক বলেছেন, নতুন করে যাত্রা শুরু এবং তা যদি ঠিকঠাকভাবে কার্যকর করা যায় তাহলে লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরের ভেঙে পড়া শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে সবকিছুর আগে ডব্লিউটিসির ফান্ডে থাকা অন্তত ২০ কোটি টাকা যাতে হরিলুট না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্কে লাইটারেজ জাহাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়েছিল। দেশের লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের নির্বাচিত কার্যকরী পরিষদের প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয় ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল।
লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) নামের তিনটি সংগঠনের সদস্যদের মালিকানাধীন জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দর এবং বহির্নোঙর থেকে বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য পরিবহন করে থাকে। তিনটি সংগঠনের আওতাধীন প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। ডব্লিউটিসি অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। কিন্তু গত বছর থেকে প্রকট হয়ে উঠা অভ্যন্তরীণ বিরোধে ডব্লিউটিসি থেকে ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) বের হয়ে আলাদা সেল গঠন করলে বিরোধ তুঙ্গে উঠে। দুইটি পৃথক সেল থেকে জাহাজ সিরিয়াল দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দফতরে বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে চট্টগ্রামস্থ নৌ বাণিজ্য দফতরের মূখ্য কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি সেল গঠন করে দেয়া হয়। বলা হয় যে, এই সেলের নিয়ন্ত্রণে এবং মনিটরিং এ জাহাজ পরিচালিত হবে। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রশ্রয়ে একপক্ষ এবং ঢাকার আওয়ামী রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়ে অন্যপক্ষ চরম বিরোধে জড়িয়ে যায়। বিরোধের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে ডব্লিউটিসি বাতিল করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি। কিন্তু ওই সেলের কার্যক্রমও খুব বেশি দূর এগুতে পারেনি। পুরো সেক্টরে মারাত্মক রকমের বিরোধ এবং ভয়াবহ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে।
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকা নেতৃবৃন্দ গা ঢাকা দেন। পট পরিবর্তনের এই সুযোগ নিয়ে জাহাজ মালিকদের নতুন নেতৃত্ব সামনে আসেন। তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয় ডব্লিউটিসির কার্যালয়ে। মারাত্মক এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে জাহাজ মালিকদের অন্যতম সংগঠন বিসিভোয়ার নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগের মানুষ হিসেবে পরিচিত সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন পদত্যাগ করেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডব্লিউটিসির কনভেনর হিসেবে থাকা নুরুল হকের উপর অনাস্থা এনে তাকে বাদ দেয়া হয়। গঠন করা হয় নতুন একটি কমিটি। ওই কমিটিরই নেতৃত্বে আজ নগরীর একটি হোটেলে ডব্লিউটিসির ‘৪৬তম সভা’ অনুষ্ঠিত হবে। ইতোপূর্বেকার সব সভাগুলো ডব্লিউটিসির কনভেনর আহ্বান করলেও এবার সভা আহ্বান করা হয়েছে নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ খানের নামে।
সভার নোটিশেনের ৩ নম্বর আলোচ্য বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ডব্লিউটিসির ব্যাংক একাউন্টগুলোতে সিগনেটরি পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। অফিসের একজন অফিসার এভাবে সভা আহ্বান করতে পারেন কিনা তা নিয়েও ইতোমধ্যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের একাধিক নেতা গতকাল দৈনিক আজাদীকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে সভা আহ্বানের সুযোগ নেই। ডব্লিউটিসি নামের কোন সংগঠনই এখন আর নেই। এর পরিবর্তে বিডব্লিউটিসিসি নামে সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এখন ডব্লিউটিসির নামে সাধারণ জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে নেয়া বিশাল অংকের টাকাগুলো হরিলুট করতেই মূলতঃ এই ধরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ব্যাংক একাউন্টের সিগনেটরি পরিবর্তনের জন্যই কার্যতঃ এমন একটি সভার আয়োজন করা হচ্ছে বলেও তারা মন্তব্য করেছেন। ডব্লিউটিসির ফান্ডে থাকা টাকা যাতে কেউ নয়–ছয় করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল জাহাজ মালিকদের নেতা, বিসিভোয়ার সাধারণ সম্পাদক ও কোয়াবের চেয়ারম্যান ইঞ্জি মেহবুব কবিরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, সেক্টরটিকে রক্ষা করতেই মূলতঃ এমন একটি সভা অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সাড়ে ৪শ’ জাহাজ কেটে ফেলা হয়েছে। শত শত জাহাজ মালিক ৩/৪ মাসের জাহাজের নাবিকসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিতে পারছেন না। অফিস ভাড়া দিতে পারছেন না। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি চলতে পারে না। আগে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে, এটা সবাই জানে। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন এই সেক্টরকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখন আমরা জাহাজ মালিকেরা মিলে আমাদের সেক্টরটিকে রক্ষা করতে চাচ্ছি। ডব্লিউটিসির ফান্ডের টাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা আমাকে চিনেন তারা জানেন যে এটাকা লোপাটের মানুষ আমি নই। আমি শুধু ধ্বংসের তলানিতে চলে যাওয়া একটি সেক্টরকে বাঁচাতে চাচ্ছি। আমরা সবাই মিলে আমাদের সবার তথা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটিকে রক্ষা করতে চাচ্ছি। তিনি এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করেন।