বিরোধের নেপথ্যে এলপিজি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ!

এলপিজি আমদানিকারক ও অপারেটরদের বিরোধ প্রকাশ্যে । ইরান নয়, ওই দুটি জাহাজের গ্যাস এসেছে দুবাই ও ওমান থেকে

হাসান আকবর | রবিবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি এলপি গ্যাস সেক্টর অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলপিজি আমদানিকারক এবং অপারেটরদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসার পর এই আশঙ্কা জোরদার হয়ে উঠেছে। এলপি গ্যাস অপারেটরদের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার বা চড়া দামে গ্যাস বিক্রির অভিযোগের পাশাপাশি আমদানিকৃত গ্যাসের উৎস নিয়েও বিরোধ চলছে। ইরান থেকে দুই জাহাজ নিষিদ্ধ পণ্য এনে বাজারজাত করার অভিযোগ ঘিরে পুরো সেক্টরে হুলুস্থূল চলছে। তবে তদারকি টিম নিশ্চিত হয়েছে, গ্যাসগুলো ইরান থেকে নয়, দুবাই ও ওমান থেকে আমদানি করা হয়েছে। বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার এবং নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এলপিজি না কেনায় এমন অভিযোগ করে অপারেটরদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের তীর এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা লোয়াবের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরীর বিরুদ্ধে। একইসাথে সংগঠনের বিশটি সদস্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টি সদস্য প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তার এমন চিঠি দেওয়ার এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। লোয়াবের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আমি শুধু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। নিষিদ্ধ দেশ থেকে পণ্য এনে কেউ যাতে দেশকে বিপদে ফেলে না দেয় সেজন্য সবাইকে সতর্ক করেছি।

বাংলাদেশে নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে দিন দিন এলপিজি শিল্পের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছর কয়েক আগেও যানবাহনে ব্যাপক হারে সিএনজি ব্যবহার হলেও এখন এর বড় একটি অংশ দখল করেছে এলপিজি। দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। এই খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর এবং বেসরকারি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বেসরকারি ২৬টি কোম্পানি বর্তমানে দেশের এলপিজির যোগান দিচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টন এলপিজি বাজারজাত করে এসব কোম্পানি। তবে এসব কোম্পানির মধ্যে ৫৬টি কোম্পানি ব্যবসা করলেও ছোটখাটো কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। বড় কোম্পানিগুলো এলপিজি চাহিদার ৮০ শতাংশ যোগান দেয়। এসব কোম্পানির সকলে লোয়াবের সদস্য। এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২০টি প্রতিষ্ঠান। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এলপিজি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক আজম জে চৌধুরী।

আজম জে চৌধুরী লোয়াবের সভাপতি হিসেবে ২৯ সেপ্টেম্বর ও ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন উপদেষ্টার কাছেও একই অভিযোগ করা হয়। এসব চিঠিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রাষ্ট্র ইরান থেকে অবৈধভাবে এলপিজি আমদানি হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। সর্বশেষ বন্দরের চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে ক্যাপ্টেন নিকোলাস ও গ্যাস জিএমএস ট্যাংকারে ইরান থেকে এলপিজি আনা হয়েছে উল্লেখ করে এলপিজি খালাস বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসহ তদন্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

ইরান থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় ওখান থেকে পণ্য আমদানির অভিযোগ নিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। রাতেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি টিম জাহাজ দুটি পরিদর্শন করে। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া না যাওয়ায় জাহাজ দুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। জাহাজ দুটি থেকে ইতোমধ্যে এলপিজি খালাস শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন নিকোলাস থেকে গ্যাস খালাস করার সময় বসুন্ধরা গ্রুপের জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ক্যাপ্টেন নিকোলাসেও আগুন লাগে, তবে তা বেশিদূর গড়ায়নি। এলপি গ্যাসের তেমন ক্ষতি হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এলপি গ্যাস আমদানি নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের উৎস আমদানি বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, দেশের চাহিদার অন্তত ৮৫ শতাংশ এলপিজি আমদানি হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এ বিপুল আমদানি মেনে নিতে পারছেন না সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী। অভিযোগ করা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানি গঠন করে তিনি ওই কোম্পানির মাধ্যমে আমেরিকা থেকে এলপি গ্যাস আমদানি করেন, যা দেশের অন্যান্য এলপিজি আমদানিকারকদের তার কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহ দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে টন প্রতি ২০ থেকে ৩০ ডলার দর বেশি নেওয়ায় আমদানিকারকরা বিকল্প উৎস মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলপিজি আমদানি করতে শুরু করেন। ব্যবসা হারানোর ফলে সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তিনি নিজের মতো করে একটি অভিযোগ দাঁড় করিয়ে সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করেছেন।

একাধিক সদস্য প্রতিষ্ঠানের মালিক জানিয়েছেন, এই অভিযোগে গ্যাস আমদানি কিংবা আমদানিকৃত গ্যাস খালাস ও সরবরাহ ব্যাহত হলে দেশের এলপিজি বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজার দখল করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।

আজম জে চৌধুরী যে দুটি জাহাজের এলপিজি খালাস বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন, সেই দুটি জাহাজে এলপিজি আমদানি করেছে বিএম এনার্জি, মেঘনা ফ্রেশ এলপিজি, যমুনা স্পেকটেক জয়েন্ট ভেঞ্চার, টিএমএসএস এলপিজি, এনার্জিপ্যাক, ইউনিট্যাঙ এলপি গ্যাস এবং জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড নামে সাতটি প্রতিষ্ঠান।

আজম জে চৌধুরীর অভিযোগের বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে গত সোমবার পাল্টা অভিযোগ দেন দুই জাহাজের আমদানিকারকসহ এলপিজি খাতের ১১ জন ব্যবসায়ী। তারা বলেন, সংগঠনের সদস্যদের মতামত ছাড়া এই চিঠি ব্যবসায়িক প্রতিহিংসা। কারণ আজম জে চৌধুরী ওমেরা এলপিজি লিমিটেড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলাদেশে একচেটিয়া এলপিজি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। অতিরিক্ত মূল্যে এলপিজি আমদানি ও সরবরাহ দেখিয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিতে অর্থ স্থানান্তর করারও অভিযোগ করা হয় চিঠিতে। তারা আজম জে চৌধুরীর বিরুদ্ধে ওভার ইনভয়েসিং করে দেশ থেকে মুদ্রা পাচারেরও অভিযোগ তোলেন।

উত্থাপিত অভিযোগ প্রসঙ্গে আজম জে চৌধুরী বলেন, সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠকে ইউরোপআমেরিকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন কোনো দেশ থেকে এলপিজি আমদানি করব না বলে সংগঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে। আমি কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চিঠি দিইনি। শুধু সবাইকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছি যে, নিষেধাজ্ঞা আছে এমন দেশ থেকে এলপিজি আনলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়তে পারে। তার অভিযোগের পেছনে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নেই বলেও জানান। তিনি বলেন, তারা যদি কম দামে পণ্য এনে থাকে তাহলে ভোক্তাদের কম দামে দিচ্ছে না কেন? এটা তো ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা।

দুই জাহাজ এলপিজি নিয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, আসলে এটা আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত নয়। অভিযোগ পাওয়ার পর একটি টিম জাহাজ দুটিতে যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাচাইবাছাই করে ইরান থেকে এলপিজি আমদানির কোনো প্রমাণ পাননি।

আজম জে চৌধুরীর চিঠির বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনা ১১টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেছেন, এলপিজি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। এই পণ্য আমদানি যে কোনোভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা দেশের জ্বালানি খাতকে অস্থিতিশীল করারই ষড়যন্ত্র। এই ব্যাপারে তারা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সজাগ দৃষ্টি কামনা করেছেন।

ডেল্টা এলপিজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক আজাদীকে বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে আমরা এলপিজি এনে দেশের ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছি। আমাদেরকে কেন শুধু সিঙ্গাপুরের এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে এলপিজি আনতে হবে? আমরা বাইরে থেকে এলপিজি আনার পরই আজম জে চৌধুরী সাহেবের মাঝে ব্যবসা হারানোর শঙ্কায় এমন উল্টোপাল্টা অভিযোগ করেছেন। আমরা কেউ ইরান থেকে এলপিজি আনিনি। তবুও একটি কথা বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশের আমদানি নিষিদ্ধের তালিকায় ইসরায়েল ছাড়া আর কোনো দেশ নেই। ইরান থেকে পণ্য আমদানি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তবে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা দেশটির সাথে বাংলাদেশের তেমন ব্যবসা নেই।

চট্টগ্রামভিত্তিক এলপিজি অপারেটর বিএম এনার্জির নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল আহসান আজাদীকে বলেন, লোয়াবের প্যাড ব্যবহার করে সভাপতি যে অভিযোগটি করেছেন সেটি তিনি ওভাবে করতে পারেন না। উনি প্যাড ব্যবহার করলেও এই অভিযোগের সাথে সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি কারো সাথে আলোচনা করেননি। ইরান থেকে এলপিজি আমদানির যে অভিযোগ সভাপতি করেছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। ইতোমধ্যে তদন্ত টিম নিশ্চিত হয়েছে, জাহাজ দুটি এসেছে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। আজম জে চৌধুরী সাহেব একচেটিয়া ব্যবসা ধরতেই এমন একটি অভিযোগ করেছেন। যে প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনায় আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে সেই একই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনিও গ্যাস কিনেছিলেন গত বছর। তিনি আনলে ঠিক আছে, আমরা আনলে ঠিক নেইএমনটি হওয়া উচিত নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরো ৩৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি দ্রুতই