বিরোধী দল খোঁজাখুঁজি

প্রসঙ্গ

শংকর প্রসাদ দে | শনিবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

১১ই এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, তিনি বিরোধী দল পাচ্ছেন না। চলমান বাস্তবতায় এটি মহামূল্যবান উক্তি। বাস্তবতা হলো সমাজ আজ রাজনীতিশূন্য। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিশূন্য। একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধীদল প্রধানতম শর্ত। প্রশ্ন হলো আমরা কোন বিরোধীদল চাইছি। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। সিপিবি ন্যাপ (মোজাফ্‌ফর) ন্যাপ (ভাসানী) জাসদ, সর্বহারা বামপন্থী আর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগের মত রক্ষণশীল দল নিয়ে এদেশের যাত্রা শুরু। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে রক্ষণশীল দলগুলো স্বাধীনতার পর অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। চীন পন্থী সর্বহারা বিপ্লবীদেরও হয়েছিল একই অবস্থা।

আরো প্রশ্ন জাগে, মস্কোপন্থী ন্যাপ, সিপিবি কোন দুঃখে, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এর বি টিম সাজতে গিয়েছিল। আসলে বঙ্গবন্ধুর কাঁধে বন্দুক রেখে ন্যাপ (মস্কোপন্থী) সিপিবি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে নিজেরা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে! বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল, আমি আগে বাঙালি অতঃপর মুসলমান। স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা মাওলানা ভাসানী শিষ্যের বিরোধিতা করে বললেন, আমি আগে মুসলমান অতঃপর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে আঘাত করতে গিয়ে ভাসানী সাহেব নিজেরই ক্ষতি করলেন।

বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি শোষিতের পক্ষে, তাইতো সংবিধানের অন্যতম মূল নীতি করলেন সমাজতন্ত্র। সিরাজুল আলম খান বললেন, আমি গুরুর সমাজতন্ত্র মানি না। আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন রব-জলিল আর তাহের ভাই, সৃষ্টি করলেন গণবাহিনী। জাসদ বঙ্গবন্ধু বিরোধিতার চমৎকার এক পটভূমি রচনা করল। একবারও খেয়াল করলো না যে, পর্দার অন্তরালে ঘাতকরা দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলেছে প্রতিবিপ্লবের জন্য। রব-জলিল-সিরাজুল আলম খান জেলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু মরলেন, সাথে মরল জাসদও। অদম্য দেশপ্রেমিক তাহের ভাই গণবাহিনীর শাখা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নিয়ে বিপ্লবের ছক করলেন জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে। বিপ্লবী সৈনিকরা হত্যা করল খালেদ-হুদা-হায়দারকে। হত্যা করা হল ২জন মহিলা সহ ১৩জন নিরীহ সামরিক কর্মকর্তাকে। এবার জিয়া বললেন, তাহের তুমি বিদায় হও। আমি পাকিস্তানী বাংলাদেশ কায়েম করব। নাছোড় বান্দা তাহের ৭/৮/৯ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা প্যারিসনকে বানালেন নরককুণ্ড। ১০ নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে জিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। এবার মুরগীর বাচ্চার মতো করে তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলালেন জেনারেল জিয়া।

আজকের বিরোধীদল শূন্যের শুরু এখান থেকে। জিয়া এক নতুন জাতীয়তা চালিয়ে দিলেন। তার নাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে জন্ম দিলেন বি এন পি। দলটির প্রতিষ্ঠাতার হাতে বন্দুক। গঠনতন্ত্রের শিরোনামে ইসলামী মূল্যবোধ। ভারত হলো শত্রু নাম্বার এক। সুযোগ সন্ধানী সব ধান্দাবাজরা ভিড়ে গেল জিয়ার বিএনপি’তে। দলটি চার মেয়াদে ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের করেছে দেশ থেকে বহিষ্কার। জিয়া নিজেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দলটির চট্টগ্রাম ইউনিটের বিরোধ মেটাতে এসে। দলটির প্রধান বেগম জিয়া কখনো জেলে, কখনো গৃহবন্দী। ১০জন কর্মী একটি মিছিল বের করতে ভয় পায়। জিজ্ঞাসা করলে বলে পুলিশের গ্রেফতার ভয়ে বউয়ের রান্নার কাজে ব্যস্ত আছি। এদের বোঝা উচিত আওয়ামী-ছাত্রলীগ-যুবলীগের বিরুদ্ধে জিয়া-খালেদা-তারেক মামলা কম দেয়নি, গ্রেফতার কম করেনি। পাখির মত লীগ কর্মী হত্যা করা হয়েছে। তারপরও লীগ কর্মীরা লুকায়নি।

বাস্তব সত্য হলো, জনপ্রিয়তার বা সমর্থকের বিচারে এখনও বিএনপি একমাত্র শক্তিশালী বিরোধী দল। জাতীয় পার্টিকে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আঁচল থেকে বের করে দেয়া হয় তবে এটি আঞ্চলিক দলের মর্যাদা ও হারাবে যে কোনো মুুহূর্ত্বে। দুটো দল’ই জন্ম নিয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। দু’টো দল’ই ইসলামী মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচতে চায়। তাত্ত্বিক কথা হল, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী নয়, বরং ইসলাম ইসলাম বলে মুখে কপট ফেনা তোলা দল দুটোকে জোর করে বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। এদের রাজনীতির মূল কথাই যখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা আর দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রীতি, তখন মুক্তিযুদ্ধের এদেশে এদের রাজনীতি ঐতিহাসিক কারণে স্তিমিত হতে বাধ্য।

বর্তমান মন্ত্রীসভা গঠনের সময় শেখ হাসিনা শরীক জাসদ, ওয়াকার্স পার্টি প্রতিনিধিদের পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করুন। বাস্তবতা হলো, যে গরু কাঁধে জোয়াল দেখার আগে শুয়ে পড়ে সেই গরু দিয়ে হালচাষ অসম্ভব। আমরা দেখলাম কয়েকটি দলের নেতারা পাজামা, পাঞ্জাবী পরে ড্রয়িং রুমে বসে স্বপ্ন দেখছেন কখন শেখ হাসিনার মোবাইল থেকে ফোন আসে।

এই যখন অবস্থা, তখন নিশীথ রাতে হারিকেন নিয়ে গরু খুঁজলে গরু পাওয়া যাবে। রাজনীতিতে আজ নিশীথ অন্ধকার। বিরোধীদল পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দল হয় মানুষের জন্য। মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে কথা বলার জন্য। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নেবার জন্য। সমাজের বৈষম্য কমানোর দাবী নিয়ে, দ্রব্যমূল্য কমানোর দাবী নিয়ে রাজপথ কাঁপাবে, জনতার মঞ্চ কাঁপাবে, মানুষের মনের দুয়ারে কাঁপন ধরাবে এমন নেতা কই? কর্মী কই? মুুক্তিযুদ্ধের স্বাপ্নিক শোষণ মুক্তির দাবী নিয়ে হাজির হবে এমন অনলবর্ষী রাজনীতিক কই? জেল জুলুম অত্যাচারকে উপক্ষো করে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোন সে মহামানব বলবে, আমি শোষণের অবসান চাই, বৈষম্যের অবসান চাই, উন্নয়ন চাই এবং যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান চাই। আমি জানি না কখন এমন একটি রাজনৈতিক শক্তির, রাজনৈতিক কর্মীর, রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব হবে। ততদিন শক্তিশালী বিরোধীদল খোঁজার মানে হবে অমাবস্যা রাতে আকাশে তারা খোঁজার নামান্তর।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামবাসীর মিলন মেলা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে