চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনসহ সর্বসাধারণের বিরোধিতার পরও নগরীর সিআরবি এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ৫০০ শয্যার একটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং একশ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ। এরইমধ্যে সব দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষে এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর আগে ডিপিপি প্রস্তুত ও চূড়ান্তের পর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে প্রকল্পটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকেও প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। অনুমোদনের পর গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে- সিআরবি এলাকায় বিদ্যমান রেলওয়ে (বক্ষব্যাধি) হাসপাতাল সংলগ্ন ৬ একর জমি জুড়ে এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলা হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান রেলপথ মন্ত্রী।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়- সরকারি জমিতে স্থাপন হলেও এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা হবে সম্পূর্ণ বেসরকারি (ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক) মালিকানায়। অর্থাৎ সরকারি জমিতে হলেও এই স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া দামে (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই) সেবা নিতে হবে জনসাধারণকে। স্বল্প খরচে সরকারি সেবা এখানে পাওয়া যাবে না। যার প্রেক্ষিতে সরকারি জমিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এই প্রকল্পটির শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনসহ সংশ্লিষ্টরা। এই প্রকল্পকে জনস্বার্থ বিরোধী বলেও অভিহিত করেছেন তাঁরা। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই ‘রেলের জমিতে ৫’শ শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ/মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষা/এই সিদ্ধান্ত জনস্বার্থ বিরোধী-বলছেন বিশেষজ্ঞরা’ শিরোনামে একটি প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আজাদী। স্বাস্থ্য খাতের সাথে সম্পৃক্ত একাধিক জনের অভিমত তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে।
বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনে সরকারি জমি প্রদানের এই সিদ্ধান্তকে জনসাধারণের স্বার্থ বিরোধী বলে ওই সময় মন্তব্য করেছিলেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহবায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, ব্যক্তি স্বার্থের জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কারণ, এতে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ সুবিধা পাবে না। ব্যক্তি মালিকানাধীন এই হাসপাতালের সেবা পেতে তাদের (সাধারণ মানুষকে) আকাশচুম্বি খরচ করতে হবে, যা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। ওই জায়গায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান।
অন্যদিকে, রেলওয়ের এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম। ওই সময় তিনি বলেন- এটি কোনভাবেই জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়। রেলওয়ে নিজেরা করতে পারতো। তাছাড়া চট্টগ্রামে বিশেষায়িত একটি হাসপাতালও নেই। সরকারি হাসপাতাল করতে জায়গা খুঁজলে পাওয়া যায় না। এখানে অন্তত বিশেষায়িত একটি হাসপাতাল করা যেতো। কিন্তু তা না করে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মানা যায়না।
তবে চট্টগ্রামের সর্বসাধারনের বিরোধিতার পরও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রকল্পটির নীতিগত অনুমোদনের পর আরো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আজাদী। ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিরোধিতার পরও সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল/৬ একর জমিতে এ হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পরদিন (২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) আজাদীর প্রথম পাতায় ছাপা হয় দুই বিশিষ্ট জনের প্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়ায় ‘এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ইস্ট-ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মু. সিকান্দর খান ও একুশে পদকে ভূষিত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম। আজাদীতে এসব প্রতিবেদন প্রকাশের পর সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে অন্তত চারটি সংগঠন। জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগ ও গণ অধিকার চর্চার আয়োজনে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে ১৭ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
আন্দোলন-প্রতিবাদের পর বেশ কিছুদিন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এ প্রকল্পের দেখ-ভাল করার দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক (প্রকৌশল) গোলাম মোস্তফা। ২০১৯ সালের ৪ জুলাই আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন তৈরিকালীন কথা হয় রেলওয়ের ওই কর্মকর্তার সাথে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্র (টেন্ডার) আহবান করে রেল মন্ত্রণালয়। এতে (দরপত্রে) ৩/৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তবে যাচাই-বাছাই শেষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপ। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সাথে সমপ্রতি রেল মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্নের কথা জানা গেছে। আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কাজ এখন শুরুর অপেক্ষায়। বিষয়টি জেনে পুনরায় প্রতিবাদে সরব হয়েছেন চট্টগ্রামের সর্বসাধারণ। অনতিবিলম্বে সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনের এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামবাসী।
প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনরাও গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন। চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবিতে না করে প্রয়োজনে অন্যত্র বেসরকারি এ হাসপাতাল স্থাপনের আহবান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।












