প্রস্তাবিত পৌরকর (হোল্ডিং ট্যাক্স ও রেইট) নিয়ে করদাতাদের অভিযোগ জানতে ‘গণশুনানি’ আয়োজনের পরিকল্পনা করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। একইসঙ্গে নগরবাসীর সামনে সরাসরি উপস্থিত হয়ে গৃহকর ইস্যুতে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করবেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এজন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মতবিনিময় সভার আয়োজন করবে চসিক।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের (রি-এসেসমেন্ট) আলোকে গত ১ জুলাই থেকে কর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করে চসিক। যার প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। বিষয়টিকে ‘বিভ্রান্তি’ ছড়ানোর অপচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন সিটি মেয়র। এ অবস্থায় গৃহকর নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করার পাশাপাশি নগরবাসীকে কর প্রদানে উৎসাহী করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে চসিক।
এ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সপ্তাহে একদিন ওয়ার্ডে ওযার্ডে মতবিনিময় সভার আয়োজন। যেখানে উপস্থিত থাকবেন মেয়র। যা অনেকটা গণশুনানির মত করে রূপ দেয়া হবে। এতে করদাতাদের অভিযোগ এবং আপত্তি শুনে সমাধান করা হবে। মাঠ পর্যায়ে কর আদায়কারী কর্তৃক কোনো করদাতা হয়রানির শিকার হচ্ছে কীনা তাও খতিয়ে দেখা হবে ওই সভায়। তবে সভা আয়োজনের দুয়েকদিন আগে সময় ও স্থান জানিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাইকিং করা হবে। যাতে করদাতারা উপস্থিত হয়ে নিজেদের অভিযোগ বা বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন। এছাড়া প্রতিটি রাজস্ব সার্কেলে খোলা হবে হেল্প ডেস্ক। এতে আপিল ফরম সংগ্রহ ও কর সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা হবে।
বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করেন সিটি মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম। তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ) মেয়র মহোদয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এতে ওয়ার্ড ভিত্তিক সভাগুলোর শিডিউল করা হবে। তিনি বলেন, ওর্যাডে ওয়ার্ডে গণশুনানির মত আয়োজন করা হবে। সেখানে আপিল ডেস্কও থাকবে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ২০১৭ সালের কর পুর্নমূল্যায়নের উপর মন্ত্রণালয় স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করায় আমরা আদায় করছি। এখানে আইনের বাইরে যাচ্ছি না। ২০১৭ সালে ধার্য্যকৃত করের উপর কারো আপত্তি থাকলে আপিল করতে হবে। আপিল রিভিউ বোর্ডে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে করদাতারা সন্তুষ্ট হচ্ছেন, যার হার ৯০ শতাংশের বেশি। এরপরও কারো কোনো সমস্যা থাকলে পথ খোলা আছে। তারা সরাসরি আমাকেও অভিযোগ জানাতে পারেন। তারপরও অনেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মতবিনিময় সভার চিন্তা-ভাবনা করছি। বিষয়গুলো সরাসরি করদাতাদের সামনে তুলে ধরব। বাস্তবতা হচ্ছে আপিল ছাড়া কর সহনীয় করার অন্য কোনো পথ খোলা নাই।
মেয়র বলেন, আমি নিজেও সবসময় বলি ২০১৭ সালের কর পুর্নমূল্যায়নে অসঙ্গতি আছে। ২০ হাজার টাকার ভ্যালুয়েশনকে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু এ অসঙ্গতি দূর করার জন্য করদাতাকে অবশ্যই আপিল করতে হবে। আইনগতভাবে অন্য কোনো পথ খোলা নাই। অতিরিক্ত হোল্ডিং ট্যাঙ ধরা হলে তা কমানোর একমাত্র উপায় আপিল। আপিল করলে রিভিউ বোর্ড কমিয়ে দিবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ কমানোর নির্দেশনা দিয়েছি। এর বাইরে মেয়রের একক কোনো ক্ষমতা নাই। মেয়র বলেন, অনেকে আবারো এসেসমেন্টে করার কথা বলছেন। সেটা তো সম্ভব না। আইন সে সুযোগ দেয়নি। আবার ট্যাঙশনে রুলস অনুযায়ী এসেসমেন্ট করলেও ভাড়ার ভিত্তিতে করতে হবে।
জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাঙ (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ রেইট রয়েছে।
এদিকে দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাঙেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬ সালে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন (রি-এসেসমেন্ট) করে চসিক। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরের ১১টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি ৩০টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পুর্নমূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।
তখন প্রস্তাবিত পৌরকরের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী ও সাবেক মেয়র মনজুর আলমও এর বিরোধিতা করেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর গৃহকর বৃদ্ধি করায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা।
এরপর একই বছরের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কমর্তকর্তারা। এতে সারা দেশের গৃহকর কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় না আসা পর্যন্ত এসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়। যা ১০ ডিসেম্বর চসিককে পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। অবশ্য এর আগে মৌখিক নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। গত ২ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব দেয় চসিক। এরপর ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুনও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চসিক।
সর্বশেষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর গত ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের এসেসমেন্ট’র আলোকে কর আদায়ে কর্যক্রম শুরু করে চসিক। গত ২৩ আগস্ট থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। আগামী ২১ অক্টোবর পৌরকরের অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে ‘গণশুনানি’ আয়োজন করবে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। এছাড়া গণশুনানিকে সামনে রেখে গত ১ অক্টোবর থেকে ওয়ার্ড অভিযাত্রা কর্মসূচি শুরু হয়। যা চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।