বিভীষিকাময় রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস

খন রঞ্জন রায় | বৃহস্পতিবার , ৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

মানবতাবোধের চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার দিন ৩রা নভেম্বর। বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। কারাগারের অভ্যন্তরে বিনা বিচারে জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ড পুরো পৃথিবীর নির্মমতার সাক্ষী। বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে বিশ্ব ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডিই অনেকের জন্য আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর রাতের অন্ধকারে নিঃস্ব একা অসহায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া বীরসেনানী জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা, যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি তাঁরা তাঁদের আদর্শের সাথে হত্যা, ক্যু রাজনীতির যোগসূত্র খুঁজে নিয়েছিল। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে প্রথমে মৃদুপায়ে পরে মরণকামড় দিয়ে তাঁদের শক্তিমত্তা জানান দিয়েছে।
প্রথমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকারীদের নির্ভয় আশ্রয় ও নির্ভরতা দেয় মসনদ দখল করা অপশক্তির প্রেতাত্মারা। স্বঘোষিত আর অঘোষিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা সামরিক পালক লাগিয়ে চলতে থাকে। দেশের ইতিহাসে বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রীকতা সামরিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে চালাতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের আদর্শিক পটপরিবর্তন ঘটতে থাকে।
মানবতাবোধের চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী ৩রা নভেম্বর। দেশের আপামর জনতা যাঁদের নেতৃত্বে ও নির্দেশে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এগিয়ে আসে; সারাজীবন ঘষেমেজে নিজেদের যাঁরা তৈরি করেছিলেন সেইসব বীরসেনানীকে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তের অক্ষরে কলুষিত ইতিহাস লেখা হয়। কারাগারের মতো কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় এ ধরনের নারকীয় হত্যাকাণ্ড সভ্য পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো চুপিচুপি জেলখানায় প্রবেশ করে। রাত দেড়টায় মূল কারা ফটকে ঢুকে তৎকালীন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ডেকে আনে। আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রপতির নির্দেশে রাত প্রায় তিনটায় হত্যাকারীরা কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। জাতীয় বীর এই চার নেতাকে একটি কক্ষে একত্রিত করার নির্দেশ দেয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমদ আগে থেকেই কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সেনা নির্দেশ মতো অন্য কক্ষে আনার সময় তিনি কাপড় পাল্টে নেন। এএইচএম কামরুজ্জামান বিনাবাধায় নির্দ্বিধায় একই কক্ষের রাস্তা ধরলেন। তাজউদ্দিন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ডাক পড়াতে তিনিও কোথায়, কেন নেয়া হচ্ছে, এই ব্যাপারে টু শব্দ করেননি । এক বাক্যে নীরবে নির্ধারিত কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন হাত মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে একই পথের পথিক হলেন। চারজন একটি কক্ষে একত্রিত হওয়ার মুহূর্তেই ঘাতক সেনাসদস্যরা নির্মম, নৃশংস নির্দয়ভাবে গুলি চালায়। ঘাতকদল তাতেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে মৃতদেহকে আবারো জঘন্য ও বর্বরোচিতভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। সফল দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পরস্পরের মিলন-বিরহের বন্ধন একত্রেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ঐতিহাসিক ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। পরে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের হয়ে সমধিক পরিচিত এই জাতীয় চারনেতা। তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কোটি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে সমকালমনস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করেন। বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানোদীপ্ততার প্রতীক হিসাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানের ধুরন্ধর বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার নীতি ও কৌশল নির্ধারণে রণনীতির বিশ্ব প্রতিভা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মেধা ও জ্ঞানের প্রতাপ দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা। কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, কোটি শরণার্থীদের তদারকি ও দেখভাল করে, মুক্তবুদ্ধির দূত হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করেছিলেন। সারা বিশ্বকে চমক লাগিয়ে খুব দ্রুত এবং অল্প সময়ে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে দেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরাজিত শক্তি ও দেশবিরোধী সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রের শিকার এই হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই ঘৃণ্য-জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সহজ-সরল আর দেশপ্রেমের সতেজ ভালবাসা মাখানো ব্যক্তিত্বদের কারান্তরালে হত্যা করে খুনিচক্র কিন্তু টিকতে পারেনি। দেশে থাকার মানসিক-মানবিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা প্রথমে বিষাক্ত পরে নষ্ট ভ্রষ্ট হয়ে দেশদ্রোহী বলেই চিহ্নিত হয়েছে।
নির্মম-নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পরদিন লালবাগ থানায় মামলা হলেও দীর্ঘ ২১ বছর বিচারের প্রক্রিয়া ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। তাঁদের উদ্দেশ্যেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিষয় ও চেতনাকে নির্মূল করা। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে জানে। জেলহত্যা মামলার বেলায়ও তাই হয়েছে। ঐতিহাসিক বিবর্তননির্ভর অপেক্ষা করতে হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর নৈর্ব্যক্তিক নিরাকার থাকার পর ১৯৯৬ সালে সুযোগ হয় বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আরোহনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত বেছে নিতে হয় নতুন করে তদন্ত প্রক্রিয়া। প্রতিক্রিয়াশীলদের উপস্থিতি এবং অপতৎপরতা মোকাবিলা করে চলে নিরপেক্ষ সৎ নির্ভিক তদন্ত। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে নাতিবৃহৎ অভিযোগপত্র বিচারের জন্য জমা দেয় পুলিশ।
আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আঙ্গিকগত দুর্বলতা। বিচারপ্রার্থী স্বজনদের শেষ অবধি দোলাচলে রাখে। চলে যুক্তিতর্ক মান অভিমান। চেষ্টা হয় এড়িয়ে চলার। নিয়তি হয়তো তা চায়নি। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রাজজ আদালত মামলার রায় প্রদান করেন। রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। বাকীদের খালাস দিয়ে কালজয়ী বিচার প্রক্রিয়ার সমাপ্তির দিকে নিয়ে যওয়া হয়। জাতীয় চার নেতা হত্যায় যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়েও বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘশ্বাস শেষ হয় ২০১৫ সালের ২রা ডিসেম্বর আপিল বিভাগের ২৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের মাধ্যমে।
বিস্মিত হওয়ার মাত্রা আরো বহুগুণ বেড়ে যায় যখন রায় কার্যকরে গড়িমসি চলে। জাতীয় চারনেতার পরিবারের সদস্যদের অগ্নিদগ্ধ জীবনের প্রতিটি স্মৃতিচিহ্ন অবিরত পুড়ছে। অপরাদের স্বর্গরাজ্যে বসবাসকারীরা এখনো নিজেদের পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই রায় আসলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের কি না! পরিবারের সদস্যরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করে অভিযোগ জানিয়েছে, জেল হত্যায় ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। এখনকার বাস্তবতা বড় অদ্ভুত। বিস্তৃত অর্থে কিম্ভুতকিমাকার। কদর্য। পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কময় জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর দীর্ঘ সময় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। দণ্ডিত ১১ জন আসামীর মধ্যে ১০জন আজও পলাতক। বাকীজন বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার দণ্ডিত ফাঁসির আসামী হিসাবে দণ্ড কার্যকর করা গেছে। গৌরীপ্রসন্‌্ন মজুমদারের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়-
‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী / তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার আর তারায় ভরা রাতি।’
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১০ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জাদুঘর’ উদ্বোধন করেন। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্মৃতি জাদুঘরকে জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসাবে ঘোষণা করে। বলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের পরপরই জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। বড় পরিকল্পনার অসম্পূর্ণ অংশ হিসাবে সেই সিদ্ধান্ত রাঙা মুলার মতো এখনো ঝুলছে। নিষ্ঠুরতা পৈশাচিকতার ভয়াল স্পষ্ট ক্ষতচিহ্ন বহন করা হাসনাহেনা সেলের নাম বদল করে মৃত্যুঞ্জয়ী সেল রাখা হয়েছে। দৃশ্যত অগ্রগতি এটুকুই।
বেদনাবিধূর-বীভৎস কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস বাঙালি জাতি চিরদিনই কালো দিন হিসাবে চিহ্নিত করে রাখবে। মুঘল দুর্গ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ-পাক কারাগার হয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার কারাস্মৃতিবিজড়িত চাঁনখারপুলের কেন্দ্রীয় কারাগার স্থলে এখন ঝুরঝুর করে জ্যোৎস্না ঝরছে। জাদুঘর, পার্ক, মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় এখনো বুনোগন্ধ। ‘জাতীয় চারনেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর’ ঔজ্জ্বল্য না হারাক, ক্রমশ চাপা না পড়ুক বিরল ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন, দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক বর্বরতার এই নির্দশন-আজকের দিনে উচ্চবাচ্যহীন এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল