‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ একটি প্রচলিত বাগধারা। এই বাগধারাটির অর্থ হলো গৃহশত্রই বিনাশের মূল বা স্বজন শত্রু। বাগধারাটি মূল উৎস, রামায়ণে বর্ণিত রাম– রাবণের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ থেকে। রামায়ণ অনুসারে বিভীষণ ছিলেন রাবণের ছোট ভাই। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় আনলেন তখন লঙ্কাকাণ্ডে অর্থাৎ সীতা উদ্ধারের যুদ্ধে বিভীষণ তার ভাই রাবণের পক্ষ না নিয়ে সীতার স্বামী রামের পক্ষ নেন অর্থাৎ রাম কে নানা ভাবে যুদ্ধে সাহায্য করেন। কারণ বিভীষণের মনে হয়েছিল রাবণ অন্যের স্ত্রী হরণ করে অন্যায় করেছেন। সীতাকে তার স্বামী রামেরই পাওয়া উচিত। তাই রাবণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভীষণ ঘরের শত্রু বই কী? ভাই হয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে পন্থা অবলম্বন করেছে। বিভীষণ ছিল রামের ভ্রাতা এবং লঙ্কার সিংহাসনে রাবণের উত্তরসূরী। রাক্ষস হওয়ার সত্বেও বিভীষণ ছিল মহৎ এবং চরিত্রবান পুরুষ। তিনি রাবণ দ্বারা সীতা হরণের কাজকে ঘৃণ্য চোখে দেখতেন এবং তিনি বারবার সীতাকে ফিরিয়ে দিতে রাবনকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু রাবণ তার কথা শুনেনি। রাবণ বিভীষণের কথা না শুনলে তিনি লঙ্কা ও ভ্রাতাদের ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দেন এবং রাম– রাবণের যুদ্ধে রামের পক্ষ অবলম্বন করে। রাম রাবণের যুদ্ধে রাবণে পরাজিত হলে বিভীষণ লঙ্কার রাজা উপাধি পান। রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণকে বিভীষণ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। রাবণ কাজটা যে অন্যায় করেছে এটা স্মরণ করিয়ে বিভীষণ সীতাকে ফেরত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু রাবণ বিভীষণের এই কথা তো শুনেন নি বরং তাকে ভৎসনা করেছে। বিভীষণ ধার্মিক হওয়ায় সে যুদ্ধে রামের পক্ষে নিল যুদ্ধে রামে জয়লাভের পেছনে বিভীষণের যথেষ্ট অবদান ছিল। তাই ধর্মের চোখে বিভীষণ ভালো হলেও রাক্ষসদের চোখে বিভীষণ রীতিমতো গৃহশত্রু, বিশ্বাসঘাতক। কোনো ঘরে যদি এমন গৃহশত্রু থাকে তাহলে সে ঘরের বা পরিবারের পতনের জন্য বাইরের পক্ষে বা শক্তির খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। গৃহশত্রুই ঘরের বা পরিবারের পতন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। এখানে উল্লেখ্য, বিভীষণ ধর্মের পক্ষে থেকেছেন কিন্তু আপন পরিবারের সাথে সে শত্রুর মতো আচরণ করেছে। আর তাই ঘরের কেউ অর্থাৎ পরিবারের কেউ শত্রুর মতো আচরণ করলে বা নিজের পক্ষের কেউ বিরোধী পক্ষের হয়ে কাজ করলে তাকে বলা হয় ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। আজকের দিনে দলের কেউ অন্য দলের হয়ে কাজ করলে বা আপন কেউ অন্যের হয়ে কথা বললে এই বাগধারা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে অর্থাৎ তাকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজকাল বিভীষণ ঘরে ঘরে। রাম রাবণের যুদ্ধে বিভীষণ ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। আর আজ বিভীষণরা স্বার্থের জন্য ভাই হয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে, সন্তান হয়ে পিতার বিরুদ্ধে এবং বন্ধু হয়ে বন্ধুর বিরুদ্ধে লড়ছে। তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাথবধ’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন বিভীষণের দ্বারা রাবণ পুত্র মেঘনাদ এর করুন পরিণতির কথা ভেবে। আমার বিশ্বাস, আজ যদি মধুসূদন দত্ত বেঁচে থাকতেন আমাদের মত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক বিভীষণদের নিয়ে ‘মেঘনাদবদের‘ ‘মত নিশ্চয় অন্য কোনো মহাকাব্য রচনা করতেন। এখন খুব প্রয়োজন ছিল মাইকেল কে, ‘সর্বত্র বধ’ নামক একটি মহাকাব্য রচনা করার জন্য। বিভীষণ একটি কাল্পনিক পৌরাণিক চরিত্র। চরিত্রটি ভাবানুষঙ্গের বাহক। বিভীষণ স্বদেশদ্রোহী, স্বজাতি দ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। এরকম অবাঞ্ছিত ও দুশ্চরিত্র যেকোনো ব্যক্তির কথা উঠলেই আমরা বলে ফেলি লোকটা ‘ঘর শত্রু বিভীষণ’। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে ও তেমন বিভীষণ আছে। পৌরাণিক রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে যেমন ছিল ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাতেও তেমনি ছিল আজও তেমনি অনেক বিভীষণ আছে। এদের ‘বধ’ করা ভীষণ দরকার।