দেশি–বিদেশি পর্যটক–দর্শনার্থীর কাছে আকর্ষণীয় স্থান প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনাঞ্চলে গড়ে তোলা দেশের একমাত্র চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে তৃণভোজী বিভিন্ন প্রাণীর প্রজননে এসেছে বিরাট সফলতা। নতুন অতিথিকে নিয়ে বেশ আনন্দে সময় পার করছে প্রাণীকুলের মা–বাবারা। আর একঝাঁক শাবকের খুঁনসুটি দেখে প্রতিদিন বেশ উপভোগ্য সময় পার করছেন পার্ক ভ্রমণে আসা দেশি–বিদেশি পর্যটক–দর্শনার্থীরা। তবে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় বিগত সরকারের সময় নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের সকল ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন শতভাগ বাস্তবায়ন হয়ে গেলেও প্রকৃত সাফারি পার্কে রূপান্তরের বিষয়টি একেবারে ঝুলে রয়েছে শুধুমাত্র একটি যানবাহন বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে। ওই বিশেষ বাহন বরাদ্দ পেতে বারবার পত্র দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের দিকে অর্থাৎ দেশের করোনাকালীন সময় একনাগাড়ে প্রায় ৫ মাস বন্ধ ছিল এই সাফারি পার্কের সকল কার্যক্রম। এতে দীর্ঘসময় ধরে পার্কের অভ্যন্তরে দেশি–বিদেশি পর্যটক–দর্শনার্থীর আগমন বা মানুষের বিচরণ বন্ধ থাকায় বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও পশু–পাখির ঘর আলোকিত করে এসেছিল একঝাঁক নতুন অতিথি। তদ্মধ্যে বাচ্চা প্রসব করেছিল বিরল প্রজাতির আফ্রিকান ওয়াইল্ড বিষ্ট, চিত্রা হরিণ, প্যারা হরিণ, মায়া হরিণ, বানর, বিলুপ্ত প্রায় কালিম পাখি, সাধারণ প্রজাতির ময়ূঁরসহ বিভিন্ন পশু–পাখির। এমনকি এই ধারা অব্যাহত থাকা সময়ে বাঘ এবং সিংহের প্রজননও বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা বাংলাদেশের সাফারি পার্কের ইতিহাসে বন্যপ্রাণীর প্রজননে বিরাট সফলতা দেখিয়েছিল।
পার্কের দায়িত্বশীলরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় যদি এই ধরনের সাফারি পার্ক বছরের ৬ মাস একনাগাড়ে বন্ধ রাখা যায়, তাহলে এসব প্রাণির প্রজননের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে এই সাফারি পার্ক। যার সুফল ইতোমধ্যে এসেছে এই পার্কে। পার্ক কর্তৃপক্ষের সরবরাহকৃত তথ্য মতে, গত তিন মাসেও একইভাবে এই সাফারি পার্কের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বেষ্টনীতে প্রজনন সফলতা এসেছে। তদ্মধ্যে বাংলাদেশে বিলুপ্ত হওয়া ভারতীয় প্রজাতির তৃণভোজী নীল গাই এর ঘরে এসেছে একটি পুরুষ শাবক। যার বয়স ইতিমধ্যে দুইমাস। ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে পঞ্চগড় জেলায় ঢুকে পড়া তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নীল গাইকে পার্কে প্রেরণের পর জুটি গড়তে সঙ্গী হিসেবে দেওয়া হয় গাজীপুর সাফারি পার্কের পুরুষ নীল গাইকে। এখানে প্রায় আট মাস থাকার পর এই দম্পতির ঘরে আসে পুরুষ শাবক নীল গাই। বর্তমানে মা–বাবার সঙ্গে বেষ্টনীতেই রয়েছে শাবকটি।
আফ্রিকান প্রজাতির শান্ত স্বভাবের জেব্রার ঘর আলোকিত করে এসেছে দুটি শাবক। তাদের বয়স আড়াই থেকে তিনমাসের মধ্যে হবে। এ নিয়ে পার্কে এই প্রজাতির জেব্রার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮টিতে। শাবকসহ এসব জেব্রা দেখতে বেষ্টনীতে বেশ ভিড় জমাচ্ছেন পর্যটক–দর্শনার্থীরা।
আরেক তৃণভোজী প্রাণী জলহস্তির ঘরেও এসেছে নতুন অতিথি। এটিসহ বর্তমানে জলহস্তির সংখ্যা ১০টি। সারাদিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা পানিতে ডুবে থাকা এই তৃণভোজী প্রাণীর বেষ্টনীতেও ঘুর–পাক খাচ্ছেন দর্শনাথীরা। পার্কে রক্ষিত লাল তালিকাভুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নিরীহ তৃণভোজী গয়ালের (তমগরু) সংখ্যা ছিল ২২টি। এই প্রাণীর ঘরে চারটি শাবক এসেছে। তদ্মধ্যে দুটির বয়স ৬ মাস ও দুই মাস করে।
বর্তমানে সাফারি পার্কে নীল ও সাদা ময়ূরের সংখ্যা বেশুমার। তদ্মধ্যে ঘর আলোকিত করেছে তিনটি সাদা ময়ূর। এসব ময়ূরকে ঘিরে মা–বাবা সার্বক্ষণিক তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রেখেছে। বিরল প্রজাতির কালিম পাখির ঘরেও এসেছে ৮টি ফুটফুটে বাচ্চা। আগে থেকেই পার্কে রক্ষিত ছিল ৬টি কালিম পাখি। অনেক যত্ন–আত্তির পর এই পাখির ডিম থেকে বের হয়েছে ৮টি ফুটফুটে বাচ্চা। যা পার্কের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
পার্কে বর্তমানে হরিণের সংখ্যা ৪৯টি। তদ্মধ্যে চিত্রা হরিণ ৪৩টি, মায়া হরিণ ৬টি। এই সংখ্যার মধ্যে ৬টি হরিণের প্রজনন হয়েছে সম্প্রতি। যা দেখতে ভিড় করছেন পার্কে আগত দর্শনার্থীরা।
আফ্রিকান প্রজাতির ওয়াইল্ড বিষ্টের সংসার বর্তমানে ৫ সদস্যের। তদ্মধ্যে তিনটি পূর্ণবয়স্ক এবং একটি স্ত্রী লিঙ্গের। এদের সংসার আলোকিত করেছে দুটি শাবক প্রসবের মধ্য দিয়ে। বয়স আড়াই থেকে তিন মাস বয়স হলেও শাবক দুটি লিঙ্গ এখনো নির্ধারণ করা যায়নি কাঁছে ঘেঁষতে না পারায়। পার্কের কুমির বেষ্টনীতে রয়েছে ১৯টি কুমির। তদ্মধ্যে লোনা পানির কুমির রয়েছে ১১টি এবং মিঠা পানির কুমিরের সংখ্যা ৮টি। বছর দুয়েক আগে লোনা পানির কুমিরের ঘরে দুটি বাচ্চা আসলেও মিঠা পানির কুমিরের প্রজননের দেখা মিলছে না। সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী বিধায় সপ্তাহের একদিনই খাবার দেওয়া হয় এসব কুমিরকে। তবে আশা করা হচ্ছে অচিরেই কুমির বেষ্টনীতে প্রজননের সফলতা দেখা দেবে।
সরেজমিন পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, হরেক রকমের পশু–পাখি ও বন্যপ্রাণীর চিৎকার–চেঁচামেচিতেই মুখর হয়ে রয়েছে পার্কটি। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন পরিবেশে গগণচুম্বি মাদার ট্রিসহ (গর্জন) পার্কের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ–গাছালির সাথে আপন মহিমায় বেড়ে উঠছে রকমারী ফুল, লতাগুল্মও। সুনশান পরিবেশে সময় কাটাচ্ছে বিভিন্ন পশু–পাখি ও তৃণভোজী বন্যপ্রাণী। লেকের পানিতে খেলা করছে সাদা বক, বেষ্টনীতে পানিতে সাঁতরাচ্ছে জলহস্তি। মানুষের শব্দ শুনলেই এখানে–ওখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির হরিণের দল মুহূর্তে ঢুকে পড়ছে জঙ্গলের ভেতর। আর বানরের দল তো পুরো পার্ক জুড়েই করছে রাজত্ব। আফ্রিকান জেব্রার দল বিশাল বেষ্টনীতে সদলবলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাঁচার ভেতর সময় কাটাচ্ছে বাঘ ও সিংহ। বাঘ এবং সিংহ বর্তমানে ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছে। এতে প্রজননের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মো. মনজুরুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, এই পার্কটির অবস্থান একমাত্র প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন–জঙ্গলের পরিবেশে। এটি শিক্ষা, গবেষণা, চিত্ত বিনোদনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথা ভারতের কানহা ন্যাশনাল পার্কের মতো যদি বছরের ৬ মাস এই পার্কটিও বন্ধ রাখা যায়, তাহলে এখানে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী ও পশু–পাখির প্রজননে বিরাট সফলতা আসবে। ২০২০ সালে করোনাকালীন অতিমারি সময়েও বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও পশু–পাখির প্রজননে সফলতা এসেছিল। তবে পার্কের কার্যক্রম বন্ধ না থাকলেও গত তিনমাসের মধ্যে অনেক বন্যপ্রাণীর বেষ্টনীতে নতুন নতুন অতিথিতে ভরপূর হয়ে পড়েছে। যা পার্কের ইতিহাসে বেশ সফলতা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে পার্কের প্রকল্প পরিচালক এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজ আজাদীকে বলেন, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটি বিদেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণীর প্রজননে বিরাট সফলতা দেখিয়ে আসছে। গত কয়েকমাসেও বিপুল পরিমাণ বন্যপ্রাণীর প্রজনন ঘটেছে পার্কটিতে। তিনি আরও বলেন, তবে এই সাফারি পার্কটিকে প্রকৃত সাফারি পার্কে (পর্যটক–দর্শনার্থীরা খাঁচায় থাকবে আর বন্যপ্রাণীরা বেষ্টনীজুড়ে উন্মুক্তভাবে বিচরণ করবে) রূপান্তরের প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে শুধুমাত্র একটি যানবাহনের কারণে। যে বাহন হবে খাঁচার মতোই। এই খাঁচার মতো যানবাহনটি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য একাধিকবার পত্র দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এখনো সেই যানবাহনটির সংস্থান না হওয়ায় পুরো পার্কটিকে প্রকৃত সাফারি পার্কে রূপান্তর করা যাচ্ছে না।












