বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক বড় ভুল। মূলত বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত সুন্দর একটি পরিবারকে নষ্ট করে দেয়। এটা কেমন যেনো আস্তে আস্তে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ভুলিয়ে ঘৃণা সৃষ্টি করে। এভাবে দুই পবিত্র ভালোবাসার বলিদানের শিকার হয় নিষ্পাপ অবুঝ সন্তানরা। সুতরাং বিবাহ বিচ্ছেদের আগে বাবা–মায়েরা হাজার বার ভাবুন!
বিবাহের খুতবাতে যে আয়াত পাঠ করা হয় তাঁর প্রথমটি হচ্ছে সুরা নিসার ১নং আয়াত। মূলত আমাদের এখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নিজের বান্দা হওয়ার পাশাপাশি সবাই আদম সন্তান হওয়ার দরুণ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান হতে বলেছেন। স্বামী–স্ত্রী প্রত্যেকে প্রত্যেকের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। সামাজিক কিংবা পারিবারিক যে/যারা অন্যান্য মানুষ অপেক্ষা আত্মীয়–স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশি থাকায় তাদের অধিকারও যেহেতু অন্যদের তুলনায় বেশি, তাই তাদের অধিকারসমূহ আদায়ে অধিকতর যত্নবান থাকা। মৌলিকভাবে এ সূরায় পারিবারিক, সামাজিক তথা বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে বিস্তারিত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বিবাহকে একটি দৃঢ় গাঁট বন্ধন করেছেন। আর এই সম্পর্কের মাধ্যমে দুজনের মাঝে পারস্পরিক বহু অধিকার জুড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। আর এই অধিকার মূলত পিঠে চাপিয়ে দেওয়া কোনো ইট–পাথরের টুপরি না যে, যা বহন করে মানুষ একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এসব মূলত পারস্পরিক ভালোবাসার মিলবন্ধন। একে অপরের অধিকার চেয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আদায় করে নেওয়া। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। –সূরা রুম ২১ আল্লাহ তায়লা স্বামীদের উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভালো আচরণ করো। অন্য আয়াতে আছে, স্বামী স্ত্রীর প্রতি স্ত্রী স্বামীর প্রতি পারস্পরিক হকের প্রতি সচেতন থাকবে। এতে সবাই ন্যায় ও সততা বজায় রাখবে। আর অভিভাবকত্ব বা দেখাশুনা ও পরিচালনার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের উপরেই দিয়ে রেখেছেন। আর তাদের দায়িত্ব নেওয়ার সহনশীলতা দিয়েই তৈরি করেছেন। তাই পুরুষের উচিত স্ত্রীর কেয়ার করা বা তাঁর ইচ্ছে ও প্রয়োজন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকা। সূরা বাকারা ২৩১– আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের বিচ্ছেদের পর আটকে রেখে জুলুম করিও না, তাহলে তুমি নিজেকে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত করবে। তালাক বা বিচ্ছেদের পরও যদি একজন মহিলার প্রতি ইসলাম এমন সম্মান বা কেয়ারের নির্দেশ দিয়ে থাকে তাহলে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা অবস্থায় এর চেয়ে হাজারগুণে স্ত্রীর প্রতি কেয়ার ও যত্নবান থাকতে হবে। পরিবারে ও সমাজে স্ত্রীর মর্যাদার প্রতি সচেতন থাকতে হবে।
আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো মুমিন ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীর প্রতিটি স্বভাবে অসন্তুষ্ট হতে পারে না। যদি কোনো একটি স্বভাবে সে অসন্তুষ্ট হয় তাহলে হয়তো তাঁর মধ্যে এমন আরেকটি গুণ রয়েছে যা তাঁকে স্ত্রীর প্রতি সর্বদা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে’। সুতরাং একটা খারাপ দিক দেখে কাউকে যাচাই করতে নেই। ভালো খারাপ মিলে মানুষ। এসব কিছু নিয়েই হয় একটি সংসার। আর এই সংসারই ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রাখে দুটি জীবনের স্বপ্নকে। এই হাদিসের মর্মার্থ, পুরুষ তাঁর অনেক দায়দায়িত্ব আছে। সে নিজের দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করবে। নিজের পরিবার, সন্তানের যথাযথ সম্মান ও খেয়াল রাখবে। যেটা তাকে আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন একটি পবিত্র বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে।
আর হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা আবার তালাককেও বৈধ করেছেন। তার মানে এই নয় যে, তা যত্রতত্র চালিয়ে দেওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা এটা করেছেন বিশেষ প্রয়োজনে ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য। এই তালাকের বর্ণনার আগেও আল্লাহ তায়ালা দুটি জীবনের বন্ধনকে ধরে রাখতে বলেছে। আল্লাহ তায়ালা মিলবন্ধনের অনেক অপশনগুলো বলে দিয়েছেন। কখনো বুঝিয়ে–সুঝিয়ে, অথবা শয্যাসঙ্গ ত্যাগ করে একা ভাবতে দিয়ে, কিংবা তাঁকে আদব শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে। সূরা নিসা–৩৪
তারপর যখন মনমালিন্য অতিমাত্রায় চলে যায়। মন ঘামানো কঠিন হয়ে পড়ে। নিজেকে মানিয়ে নেওয়া কোনো মতে সম্ভব না। তখনো ইসলাম বলছে, তালাক টা ধীরস্থির ভাবে দাও। একেবারে তিন তালাক বলে সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে বিপদে পড়ো না। নিজের রাগকে কিংবা স্ত্রীর অতিরঞ্জন আচরণ দমিয়ে রাখতে একটি তালাক দিয়ে রাখো। যাতে রাগ কমলে সংসার না ভেঙে পুনরায় ইদ্দতের মাঝে ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকে। তাই ইসলাম তালাকের পরের ইদ্দত স্বামীর বাড়িতে কাটানোর বিধান রেখেছে। যাতে তাদের পরস্পরের মধ্যে আবার বুঝাপড়া হয়ে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারে। তালাকের অধিকার পুরুষকে দিয়েছে কারণ সেই নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে স্ত্রীকে ফিরে পেতে চাইবে। কারণ মা–বাবা ছাড়া পরিবারের সন্তানদের যত্ন অন্যকেউ পরিপূর্ণ নিতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, তালাক (বেশির বেশি) দুইবার হওয়া চাই। (এতে স্বামীর জন্য দুটি পথ খোলা থাকে) হয়ত সে স্ত্রীকে বুঝিয়ে রেখে দিবে। নাহয় ইদ্দত শেষ করার মাধ্যম স্ত্রীকে বিদায় দিবে। সূরা বাকারা–২২৯
আর সূরা বাকারার –২২৮ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, স্বামীদের উচিত স্ত্রীদের ইদ্দত শেষ হওয়ার আগে ফিরিয়ে আনা যদি তারা এই সমাধানটি চাই। আর যদি না চাই তাহলে ইদ্দত শেষ করার মাধ্যমে স্ত্রীকে বিদায় দিবে। তাও তাদের মোহরানার হক আদায় করে। আর এসব কিছু আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন–
যাতে সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে হাজারবার ভাবতে পারে। কারণ একটা সম্পর্ক ভাঙ্গনের পরিণাম অনেক ভয়াবহ। জীবনের স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো বারবার মনে পড়ে এতে মানুষ মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ভালোবাসা হারানোর বেদনায় বাকি জীবন কষ্টে পার করে। সংসারে সন্তান হয়ে গেলে তারা–ও মাতৃত্বের ছায়া হারায়। বাবা–মার নিখুঁত আদর, সোহাগ আর ভালোবাসা হারিয়ে আজীবন একটা ভারিমন বহন করে চলে। সন্তানের চেহারার দিকে তাকিয়ে সব অভিমান ভুলে গিয়ে সুন্দর সংসার করা যায়। তাই ঘৃণার দেয়াল দাঁড় করার আগে হাজারবার ভাবুক এটাই মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে আদেশ দিয়েছেন। তাই তো বলেছেন, তালাক হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল শব্দ। যাকে প্রয়োজনের স্বার্থে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সাবধান! আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন। আপনার সামান্য ইগোর কারণে নিজেদের সন্তানের হক নষ্ট করবেন না। তাদের লালন পালনে অবহেলা করবেন না ।
বিবাহ হচ্ছে অন্যতম বড় একটি ইবাদত। এই ইবাদতের কারণে সকল অনৈতিক পাপ থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত রাখে। সঠিক নিয়ত এবং উত্তম সঙ্গী একটি সুন্দর জীবন গঠনে অনেক সাহায্য করে। এসব গুণাবলী রয়েছে একজন উত্তম মানুষের মাঝে যার দ্বীনের প্রতি মুহাব্বত ও ভালোবাসা রয়েছে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দ্বীনদারিত্ব সবকিছুর উপরে। যা একটি পরিবারকে জান্নাতের মতো সুন্দর করে তুলে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। আর তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের নিকট আমানত। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ওছিয়ত। তোমরা এই আমানতের প্রতি দুর্ব্যবহার করবে না। সৎ পুরুষরাই নারীদের সম্মান করতে জানে। যারা নিকৃষ্ট তারাই নারীদের অপমান করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা দাসকে তার মনিবের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
সুতরাং তোমরা একে অপরকে সংশোধন করতে হলে প্রথমে সবর আর ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। সবর আর হিকমতের সাথে বুঝিয়ে সংসারকে আগলে রাখতে হবে। আর ক্ষমা মহৎ গুণ। একে অপরকে ক্ষমা করে শিখিয়ে দিয়েই সুন্দর জীবন যাপন করতে হবে। সবরই সুন্দর আরেকটি ভোরের দরজা। এই সবরের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা সেই মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন। সূরা আলে ইমরান ১৩৪।
ড. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দির রহমান আল বা’য়জান হাফিজাহুল্লাহ :
খতিব, মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ার।