এই যে শীতের শেষ আর গরমের শুরু। বলছিলাম চৈত্রমাসের কথা। পাতাঝরার কথা, বসন্তের কথা। পাতাঝরার দিনগুলোতে অদ্ভূত এক বিষন্নতা পেয়ে বসে। একটা একটা করে ঝরে পড়ছে পাতা। আর দক্ষিণের হাওয়ায় সে পাতা উড়ছে টিনের চালে, উঠোনে, পথেঘাটে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে। গাছগুলো কেমন যেন কঙ্কালসার হয়ে থাকে। কচি কচি পাতারা সবে ডালে মেলছে। আবার কোথাও কোথাও বিবর্ণ পাতা, সবুজপাতা পাশাপাশি মিলেমিশে রয়েছে। সন্ধ্যায় যখন হাঁটতে বেড়োই বাতাসে পোড়া গন্ধ পাই। পাতা পোড়ানোর গন্ধ। মন কেমন করা। আমায় নিয়ে যায় আমার বাড়ির উঠোনে সেই পাতা পোড়ানোর গন্ধে। অনেক গাছগাছালিতে ভরা বাড়ি। যে বাড়িতে সূর্যের দেখা পাওয়া কঠিন ছিলো। পাতার ফাঁকফোঁকরে যা একটু দেখা যেতো, মা ভেজা কাপড় শুকানোর জন্য এই দড়ি ঐ দড়িতে ঘুরপাক খেতো। বাড়িতে মায়ের এই কাপড় মেলার একটা নামও দিয়েছিলেন ব্যঙ্গ করে। এখন মনে পড়ছে না।
সারাদিনের পাতার স্তুপে বাবা আগুন জ্বালিয়ে দিতো। বাড়িময় ধোঁয়া। গন্ধটা এখনও টের পাই খুব। বাবাকে খুব মনে পড়ে আগুনপোড়া দেখলে। এই পাতা পোড়ানোর সাথে আমার কি এমন স্মৃতি থাকতে পারে তা বোধগম্য নয়। তবুও এই গন্ধ পেলে চলতি পথে হোঁচট খাই, পিছন ফিরি। ঘ্রাণ নিই। বাড়ির উঠোনে প্রতিদিন বসতো নানান গল্পের সম্ভার নিয়ে বাবা। প্রায়শই জমে ওঠে চা আর দু’ পিস বিস্কিটে রাজনীতি, দেশ সমাচার, শৈশব, কৈশোর, সংসারের যাবতীয় টানপড়োনের গল্প। পাতা পুড়ে নিভুনিভু। বাবা নেড়েচেড়ে দিচ্ছেন। আবার আগুন জ্বলে ওঠে। আগুন পোড়া উৎসুক জনতায় আমিও আছি। বাবার মতো আমিও যে আড্ডাবাজ। চকচকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিলো আমাদের! মাড়িয়ে যাওয়া পাতার শব্দরা বুকে এসে বিঁধে। বিবর্ণরঙের পাতা মাড়িয়ে যে পথচারী চলছে তার চলন দেখি। তাঁর পিছনে হাঁটতে হাঁটতে সবকিছু থেকে দূরে সরে যাই। পাথরের ঘেরাটোপেও বসন্তের দেখা পাই। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া ডালে ডালে। দৃষ্টি এড়াতে পারিনা। আকাশ জুড়েই মায়াবী চাঁদের আলো। এখন বাবা নেই। আমাদের সেই বাড়িও নেই। যে বৃক্ষটির ছায়াতলে বসতো সবাই কিছুক্ষণ। যেখানে সমস্ত উন্মাদনা, গমগমে পরিবেশ, উত্তেজনা চা-এর কাপ-এর ঝড় তোলা, কিচ্ছুটি আর নেই। ডুবে যায় সব। সম্পর্কগুলো ঢেকে রাখা এখন চোরাবালিতে। সূর্যাস্তের রাঙা রঙে চোখ নামিয়ে দেখা হচ্ছে না আর। তার আর কোন গল্প থাকে না। ফিরে যাওয়া হয় না প্রতিচ্ছবির কাছে। যেদিন গেছে একেবারেই গেছে। মন খারাপ হলে একা হতে ইচ্ছে করে খুব। বৃক্ষটির ছায়াতলে বসতে কিছুক্ষণ। বিবর্ণ পাতারা পড়ে থাকে পায়ের কাছে। এবং সেদিনের গল্পও।