বিপ্লব উদ্যানকে সবুজ নাগরিক চত্বর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে

তাসলিমা মুনা | শনিবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বিপ্লব উদ্যান’ নামটিতে যেমন মুক্তি সংগ্রাম, ও শহীদের আত্মত্যাগ প্রতিভাত হয়, অন্যদিকে উদ্যান’ শব্দটি গাছপালা শোভিত সবুজ প্রাকৃতিক অঙ্গনের অর্থ বহন করে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহরে অবস্থিত বিপ্লব উদ্যান ও তৎসংলগ্ন প্রায় ৮ একর এলাকা একসময় সম্পূর্ণ সবুজ উন্মুক্ত উদ্যান হিসাবে সুপরিচিত ছিল। সময়ের সাথে অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবায় নগরীর প্রাকৃতিক উদ্যানগুলো অতি দ্রুত দখল হয়েছে, উজাড় হয়েছে মহামূল্য গাছপালার আচ্ছাদন। পূর্বের আয়তন কমে বর্তমানে বিপ্লব উদ্যান নেমে এসেছে দুই একরের নিচে। সবুজ এই স্থান ছিল ব্যস্ত শহরের কোলাহলের মধ্যে নাগরিকদের জন্য এক টুকরো প্রশান্তি, এখানে দেখা মিলত অসংখ্য পাখী, কাঠবিড়ালি সহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র প্রজাতির। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এই স্থান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে, বৃষ্টির পানি শোষণ করে নগর বন্যার প্রকোপ কমাতে, বায়ুর গুণাগুণ রক্ষা ও শব্দ শোষণ সহ নানা উপায়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে।

১৯৩১৩৪ সনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বীর নগরী চট্টগ্রামের গৌরবগাথা। সেই সময় এই এলাকাকে কেন্দ্র করে চট্টলাবাসী এক সফল সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করে। বিপ্লব উদ্যান বীর কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ স্বাধীনতাকামী বহু শহীদের আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করছে। এরপর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে এখান থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এসমস্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণীয় করে রাখতেই আশির দশকে বিপ্লব উদ্যান’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

প্রাকৃতিক উদ্যান ধ্বংস করে বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন।

কয়েক বছর আগে এই উদ্যানে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এখানে সংস্কার কাজ শুরু করে। তথাকথিত এই সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের প্রয়োজনে কাটা পড়ে বৃক্ষরাজি। সবুজের আবরণ নষ্ট করে পুরো এলাকা জুড়ে নির্মাণ হয় খাবারের দোকান সহ বিভিন্ন কংক্রিটের স্থাপনা। এর মাঝে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের রদবদল হয়, সেই অনুযায়ী এখানকার নির্মাণ কাজের ধারাও একাধিকবার পরিবর্তন হয় এবং ধাপে ধাপে চলতেই থাকে। ক্রমে পুরোপুরি হারিয়ে যায় বিপ্লব উদ্যানের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। খাবারের দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে জনসমাগম ও ব্যবসা রমরমা হলেও বাস্তবিক বিপ্লব উদ্যান আজকের পরিনত হয়েছে গাছপালাঘাস শুন্য, জনভারে পিষ্ট, ময়লা আবর্জনা ছড়ানো শ্রী হীন হাটবাজারে। সাধারণ নাগরিকের নির্বিঘ্ন সমাগম, প্রশান্ত বিনোদন বা কোলাহল মুক্ত সবুজ পরিসরে অবসর কাটানোর আকাঙ্ক্ষা এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এতে কেবল চট্টগ্রামবাসীর গৌরবজনক অধ্যায় সমূহই কলুষিত হয়নি, নষ্ট হয়েছে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর করার সম্ভাবনা।

কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আইন ২০০৯ এর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই আইনের ২৪ ধারার প্রতিটি অনুচ্ছেদে বৃক্ষ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সর্বসাধারণের সুবিধার জন্য খোলা জায়গা সংরক্ষণ, সাধারণ উদ্যান নির্মাণ, তৃণাচ্ছাদন ও মানোন্নয়ন করার বিধান বর্ণিত আছে। এই সংস্থার ‘মিশন ও ভিশন’ এ উল্লেখ আছে নগরীর সৌন্দর্য বর্ধন ও সবুজায়নের মাধ্যমে পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন’ এর শর্ত। অতএব এটা স্পষ্ট, বিপ্লব উদ্যানের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে।

১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করার সময়ই চট্টগ্রামে উন্মুক্ত পরিসরের পরিমাণকে সংকটাপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয় এবং সেই প্রেক্ষিতে এই পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। সেখানে বিপ্লব উদ্যানকে ‘নগর উদ্যান / নির্দিষ্ট সবুজ এলাকা (চঁনষরপ ঙঢ়বহ ঝঢ়ধপব)’ হিসেবে চিহ্নিত করে, প্রাকৃতিক উদ্যান হিসাবে সংরক্ষণ করার কথা বলা আছে। এই স্থানকে বিশেষভাবে, মাস্টার প্ল্যানের ‘ঈবহঃৎধষ এৎববহ ইবষঃ’ অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে এটি ভবিষ্যতেও উদ্যান হিসেবেই থাকে এবং অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না হয়। এর পরবর্তী মাস্টার প্ল্যানগুলোতেও উন্মুক্ত পরিসর সংরক্ষণ ও বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ খেলার মাঠ, মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ (অপঃ ঘড়. ঢঢঢঠও ড়ভ ২০০০), এই আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী, কোনো মাস্টার প্ল্যানে উদ্যান বা মুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারিত জমির শ্রেণি পরিবর্তন, দখল বা বাণিজ্যিক ব্যবহারে পরিবর্তন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। উক্ত আইনের ধারা ২() এবং ২() অনুযায়ীও মাস্টারপ্ল্যানে এই স্থানের শ্রেণি পরিবর্তন, নির্মাণ কাজ কিংবা কাঠামো স্থাপনআইনের ব্যত্যয় হিসেবে গণ্য হয়। অতএব বিপ্লব উদ্যানের জায়গায় দোকানপাট বা বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা এই আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। এছাড়া, সমপ্রতি প্রণীত জাতীয় নগরায়ণ নীতিমালা, ২০২৫ তে নগর পরিবেশের টেকসইতা ও বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে এর অনুচ্ছেদ ৪..২ তে সবুজ অবকাঠামো ও প্রকৃতি নির্ভর সমাধানের (ঘধঃঁৎবইধংবফ ঝড়ষঁঃরড়হং) এর কথা বলা হয়েছে। যার আওতায় রয়েছে পার্ক ও সবুজ করিডোর বাড়ানো ও সংরক্ষণের মাধ্যমে নগর সমপ্রসারণ কর্মসূচী।

বিপ্লব উদ্যানকে একটি পরিবেশ বান্ধব নাগরিক মুক্তাঙ্গন হিসাবে গড়ে তোলা হোক বিপ্লব উদ্যানে বৃক্ষ নিধন করে দোকান ও কংক্রিটের স্থাপনা করা ও ভবিষ্যতে বহুতল ভবনের পরিকল্পনার বিষয়ে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। ২০২৩ সালে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম (ঋচঈ) সকল প্রকার ইটকংক্রিটের স্থাপনা সরিয়ে ফেলে বিপ্লব উদ্যানকে আগের মতো সম্পূর্ণ সবুজ উদ্যান হিসাবে সংরক্ষণ করার সুপারিশ জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। অতি সমপ্রতি এখানে আবারো বহুতল ভবন ও বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়ে জানা গেলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের পক্ষ থেকে মেয়র মহোদয়কে আবারো চিঠি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ।

বিপ্লব উদ্যান শুধু একটি গতানুগতিক বিনোদনের জায়গা নয়, এটি নাগরিক পরিবেশ, ইতিহাস ও সমাজচেতনার সমন্বিত প্রতীক। তাই একে একটি পরিবেশ বান্ধব নাগরিক মুক্তাঙ্গন হিসাবে গণ্য করাটাই সমীচীন হবে। এই উদ্যানটি হতে হবে উন্মুক্ত। এখানে সবার সহজ ও নিরাপদ প্রবেশগম্যতা ও আশপাশের এলাকার যানবাহনের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চারপাশে স্থানীয় ছায়াদায়ী বৃক্ষ বেষ্টনী, মাঝখানে ঋতুভিত্তিক ফুলফলের গাছ রোপণ করা যায় যা পাখী ও প্রাণীদের আশ্রয় প্রদান করবে। গণ শৌচাগার, প্রয়োজনীয় আলো ও নিরাপত্তা ক্যামেরা, ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পচনশীল বর্জ্য ফেলার আলাদা বিন ইত্যাদি মৌলিক সুবিধা থাকা অত্যাবশ্যকীয়। পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য নীতি অনুসরণ করে হাঁটার পথ, বসার বেঞ্চ, প্রতিবন্ধীদের জন্য র‌্যাম্প ও পথ,এবং শিশু ও প্রবীণদের উপযোগী পরিসর গড়ে তোলা যায়। অযাচিত ভিড়, বিশৃঙ্খলা এড়াতে এবং অতিরিক্ত বর্জ্য তৈরি হয় বিধায় কোন খাবারের দোকান বা রেস্টুরেন্ট এই ধরনের নাগরিক চত্বরে রাখা উচিৎ নয়। দোকানগুলো উপযুক্ত স্থানে সরিয়ে এখানে বরং অত্যন্ত সীমিত পরিসরে পানীয়, বাদাম বা প্যাকেট জাত হালকা খাবার বিক্রির দুইএকটি কাউন্টার রাখা যায়। সবুজায়ন অক্ষুণ্ন রেখে এই উদ্যানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ফলক বা ম্যুরাল স্থাপন করা যেতে পারে। বৃষ্টির পানি শোষন করে নগর বন্যার প্রকোপ কমানোর জন্য সব ধরনের অভেদ্য সিমেন্টের মেঝে বর্জন করে জলশোষক পথ/মেঝে /ঢ়বৎসবধনষব ংঁৎভধপব ব্যবহার করা অত্যাবশ্যকীয়।

ব্যস্ত শহরে জলাশয়সহ সকল প্রাকৃতিক উদ্যানের গাছপালা, ফুল ও সবুজের আবরণ নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন, বায়ু দূষণ, ও নগর বন্যার রোধে অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নগরে বৃক্ষ রোপন ও সবুজায়ন বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি মাননীয় মেয়র মহোদয় চট্টগ্রাম নগরীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্মুক্ত পরিসর ’সার্কিট হাউজ ময়দান’ সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রামবাসীর দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা, বিপ্লব উদ্যানের ক্ষেত্রেও তিনি আইন, নগর পরিবেশের প্রতি অনুরূপ দায়িত্বশীল হবেন এবং সুবিবেচনার পরিচয় দেবেন। নগর বাসীকে সবুজ উদ্যানের প্রাকৃতিক আশ্রয়ে সৃজনশীল সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করবেন।

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্যামল মিত্র : বাংলার সংগীতাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে