বিপিসির তেল পরিবহনে বিরাট সিন্ডিকেট

কোটি কোটি টাকার তেল চুরিসহ নানা অপকর্ম বছরের পর বছর

হাসান আকবর | শুক্রবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

দেশের জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বছরে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল বাজারজাত করে। এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের অন্তত ৮২ শতাংশ পরিবাহিত হয় নৌপথে। ১০ শতাংশ পরিবাহিত হয় রেলপথ এবং ৮ শতাংশ সড়ক পথে। গত বছর বিপিসি প্রায় ৫৪ লাখ টন জ্বালানি তেল নৌপথে পরিবহন করে। নৌপথে জ্বালানি তেল পরিবহনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয় সংগঠিত বিরাট একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সিন্ডিকেট ভেঙ্গে যাওয়ার আশা করা হলেও পুরানো রাঘববোয়ালেরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারের ( জাহাজ) মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পরিবহনকালে কোটি কোটি টাকার তেল চুরিসহ নানা অপকর্মের ঘটনা ঘটে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সংঘবদ্ধ এই সিন্ডিকেটে বেসরকারি জাহাজ মালিক, বিপিসি এবং তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরাও রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের জ্বালানি তেল আমদানি থেকে বাজারজাত পর্যন্ত পুরো কার্যক্রমই বিপিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি দেশব্যাপী জ্বালানি তেল বাজারজাত করে। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল উপরোক্ত তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে সারাদেশে সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো হয়। দেশে জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপো চট্টগ্রামে। এখান থেকে সারাদেশে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। মোট চাহিদার অন্ততঃ ৮২ শতাংশ জ্বালানি তেল নৌপথে অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন করা হয়। বহু বছর ধরে দেশের নৌপথে জ্বালানি তেল পরিবহনের বিষয়টি বেসরকারি জাহাজের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। এক সময় জাপানের তৈরি বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হতো। ওই সময়ও জাহাজ থেকে তেল চুরি ওপেন সিক্রেট ছিল। নদীর মাঝখানে তেল চুরি করে জাহাজে নদীর পানি ভরে দেয়ার মতো বহু ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। এক পর্যায়ে এসে প্রায় ৭০টি জাপানি জাহাজকে বয়সের কারণ দেখিয়ে বহর থেকে বের করে দেয়া হয়। নতুন করে নেয়া হয় দেশীয় জাহাজ।

বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই সরাসরি ৫৩টি তেলবাহী জাহাজকে বিপিসির বহরে যুক্ত করা হয়। শুধুমাত্র একটি চিঠি দিয়ে উক্ত ৫৩টি জাহাজকে তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির তেল পরিবহনে যুক্ত করা হয়। উপরোক্ত ৫৩টি জাহাজই দেশীয় তৈরি এবং সবগুলোই আওয়ামী লীগ এবং কয়েকজন আমলার মালিকানাধীন বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বিপিসির বহরে থাকা মোট ১৪৩টি ট্যাংকারই দেশে তৈরি। ২০১০ সালের পরবর্তীতে জ্বালানি তেল পরিবহনের সাথে যুক্ত হন রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাও। অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসাটিতে বাগিয়ে নিতে উপরমহলের চাপে বিভিন্ন সময় বাড়ানো হয় জাহাজের সংখ্যা।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, তেল পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে ১৭৭টি জাহাজ। এর মধ্যে ১১৮টি জাহাজই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতা এবং প্রভাবশালী কয়েকজন আমলার মালিকানাধীন।

বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা নীতিমালা অনুযায়ী জাহাজ নিয়ে থাকি। এখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। জাহাজটি তেল পরিবহনের যোগ্য কিনা সেটা দেখেই পরিবহন কাজে যুক্ত করা হয়। জাহাজের মালিক কে সেটা বিবেচনা করা হয় না। ৪০ বছরের বেশি পুরোনো জাহাজ জ্বালানি তেল পরিবহনে রাখা হয় না উল্লেখ তিনি বলেন, ওই ধরনের জাহাজে জ্বালানি তেল পরিবহন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

বিনা টেন্ডারে বহরে জাহাজ যুুক্ত করার ব্যাপারে তিনি বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেবো ভাই। কেন জাহাজগুলো নেয়া হয়েছে তা আমরা যেমন জানি, আপনিও জানেন। তিনি বলেন, আমাদের বহরে থাকা জাহাজগুলোই তেল পরিবহন করছে। তবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা পুরোদমে চালু হলে আমাদের বহর থেকে বহু জাহাজই বাদ দিতে হবে। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা কোনো সিন্ডিকেট নয়। আমাদের বহরে থাকা জাহাজগুলোই মূলতঃ আমাদের তেল পরিবহন করে। বাইরের কোনো জাহাজের তেল পরিবহনের সুযোগ নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র শবে বরাত আজ
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় ২০১৪৫ পরিবার পাচ্ছে টিসিবির ভোগ্যপণ্য