দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পর্বতসম চাপে জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। বহুদিন আগে ’উত্তরের সুর’ সিনেমায় দেখেছিলাম ঈদ এলে পোলাও মাংস খেতে হয়। মধ্যবিত্তের জন্য এখন এটিই প্রযোজ্য। মধ্যবিত্তের শরীরে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সপ্তাহে একবার মাছ-মাংস খাওয়ার চিন্তা করতে হয় বৈকি। মধ্যবিত্তরা এখন চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। মধ্যবিত্ত বলতে এখন আর কিছু নেই। এখন আছে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত। গত ৫ আগস্ট মধ্যরাতে জ্বালানির রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধির পর লাগামহীন ভাবে দফায় দফায় সব দ্রব্যমূল্যের যে গগনচুম্বী বৃদ্ধি তাতে এখন দু’মুঠো ভাত আর এক গজ কাপড়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম চলছে সাধারণ মানুষের জীবনে। উর্ধ্ব গতিতে কৃষিপ্রধান দেশে এখন সরু চালের কেজি ৮০ টাকা। এক হালি ডিম ৫৫ টাকা। ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজিতেই হাত রাখা যায় না। তেলের কথা বাদই দিলাম। মাছ, মুরগি ও মাংসের দিকে মধ্যবিত্তরা আর তাকায় না। সেগুলো এখন ঈদ ও অন্যান্য উৎসবের খাবার। খাবার খরচ বাদ দিলেও তো রয়েছে সন্তানের লেখাপড়া, বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধ, যাতায়াত, গ্যাস, পানি, ওয়াই-ফাই সবকিছুর খরচ। এসব খরচের জাঁতাকল যেন পিষছে মধ্যবিত্ত সমাজকে। তাই তো লোকে কী বলবে তার পরোয়া না করে মধ্যবিত্তরাও এখন দাঁড়ায় টিসিবির লাইনে। সারাদিন দাঁড়ালেও যে টিসিবির পণ্য পাওয়া যাবেই, এটা কিন্তু নিশ্চিত নয়। আর আমাদের দেশে যা ঘোষণা করা হয়, তা যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে,এটাও কোথাও বলা নেই। যদি তা হতো, তাহলে শহর, মফস্বল-গ্রাম গুলোতে এক ঘণ্টার লোডশেডিং এর কথা বলে, দু’ঘণ্টা হতো না। মাঝে মাঝে তো প্রত্যন্ত গ্রামে এও বলা হয় বিদ্যুৎ নাকি মিসকল দেয়। এভাবেই চলছে ডিজিটাল দেশের মানুষের ডিজিটাল জীবন। উন্নয়নের প্রবল স্রোতে মধ্যবিত্ত এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। তাহলে বিদ্যুৎ ঘাটতির এদেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বিদ্যুৎ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার রং বাহারি গল্পের উল্লাস গাথার নামে হাতির ঝিলে আলো ঝলমলে শোডাউনের দরকার কী ছিল? সব এখন দেখা যাচ্ছে শুভংকরের ফাঁকি। আওলাদ হোসেন (ছন্দ নাম) বসবাস করেন চট্টগ্রাম শহরে। বেসরকারি অফিসের একজন কর্মকর্তা। মাসে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। তার পরিবারে তিনি, তার স্ত্রী ও দুটি সন্তান রয়েছে। চারজনের সংসার। বেশ চিন্তায় পড়েছেন তিনি। একবার ভাবছেন, কিছুটা কম ভাড়ায় বাসা নেবেন।
ডিপিএসটা ভেঙে ফেলবেন। আবার ভাবছেন স্ত্রী সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিলেন আরেকটু অপেক্ষার। দেশের পরিস্থিতি কী হয় দেখা যাক। তার বাসা ভাড়াসহ বিভিন্ন বিলের পেছনে ১২ হাজার টাকা চলে যায়। দুই বাচ্চার লেখাপড়ার পেছনে যায় প্রায় ৭ হাজার টাকা। বাজার খরচ ১০ হাজার টাকা। যাতায়াতসহ হাত খরচ ৫ হাজার টাকা। মাসে ২ হাজার টাকার ডিপিএস। এছাড়া অন্য কেনাকাটা আছে, মাঝে মধ্যে বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মার জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হয়। মোট কথা, টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাজার খরচ, যাতায়ত খরচ প্রায় সব খাতেই খরচ বেড়েছে। আগে ৪০ হাজার টাকায় যেভাবে চলতেন তিনি, এখন সেভাবে চলতে হলে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। কিন্তু তার কি আয় বেড়েছে? এ অবস্থায় হয়তো দুই-তিন মাস চালিয়ে নিতে পারবেন তিনি তার সংসার। কিন্তু এর পর কী ! কীভাবে সংসার চলবে তার? এবার একটি খবরের দিকে মনোনিবেশ করা যাক। খবরটির শিরোনাম-‘বিশ্ববাজারে ফের কমলো তেলের দাম’ (দৈনিক দেশরূপান্তর, ১৬ আগষ্ট’২২)। তাতে বলা হয়, ‘বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেলের আমদানিকারক দেশ চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীর গতি এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে। চীনে চাহিদা কমে যাওযায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবারও কমেছে। ১৫ আগষ্ট বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচারসের দাম প্রতি ব্যারেল (এক ব্যারেল= ১৫৯ লিটার) ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে ৯৭ দশমিক ১ ডলারের নেমেছে। এছাড়া একইদিনে প্রথম স্টেশনে যুক্তরাষ্ট্রের বেংচমার্ক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দাম কমে ৯১ দশমিক ৩ ডলার হয়েছে। এর আগে প্রথম সেশনে এ তেলের দাম ২ দশমিক ৪ শতাংশ কমে যায়’। তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম এত কমে যাওয়া সত্ত্বেও কেন তেলের দাম বাড়ানো হলো? সরকারের খোঁড়া যুক্তি বা অজুহাত-বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েছে, তাই নিরুপায় হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। কথাটি ধোপে টেকে না। দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে তেল আমদানীতে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সরকারি প্রধান তথ্যসূত্র বাংলাদেশ ইকোনোমিক রিভিউ’২০২২ ( জুন ২০২২-এ প্রকাশিত) বলছে উল্টো কথা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। উপরন্তু এই সময়ে (২৩ মে ২০২২ পর্যন্ত) মোট মুনাফা করেছে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ পয়সা (প্র:আলো’১৬ আগষ্ট’২২)। গত কয়েক মাসে যে লোকসান হয়েছে, তার তুলনায় এই লাভ কয়েক গুণ বেশি। তার মানে সরকার জনস্বার্থ ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে লাভের টাকার একাংশ দিয়ে এই লোকসান ঠেকাতে পারত। কিন্তু সরকার সাধারণ জনগোষ্ঠির পকেট কাটারই সিদ্ধান্ত নিল। তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির মতো ’ডমেনো’ প্রভাব পড়বে সেটা কি ধর্তব্যে আনেননি? বা নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে কার্যকর কোনো চিন্তা-ভাবনা করেননি? টাকা পাচারের মহোৎসব, চরম দুর্নীতি, জবাবদিহিহীন নৈরাজ্যজনক প্রশাসন ও চরম অব্যবস্থাপনাকে লাগাম টেনে না ধরে উল্টো পথে হাঁটলো। জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি অন্য সব পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেয়। পণ্যের উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণ-প্রতিটি স্তরে এর নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান। মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ। যা এখন সত্যিই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
পরিবহন খাতে তো এর নেতিবাচক প্রভাব চরমে, যা রীতিমত নৈরাজ্যকর। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির অবস্থা দেখে মনে হয়, সরকারি কতৃপক্ষ ও পরিবহন মালিক মিলে প্রকৃত ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া ও ব্যয়ের বিশাল বোঝার সবটাই ভোক্তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার সহ্য করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই অসীম নয়। এ তো গেলো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ। তার সাথে আছে নিরাপত্তাহীন জীবন। রাজপথে চলতে ফিরতে মনে হয় এদেশে জীবনের দাম অতি তুচ্ছ। প্রতিদিন মহাসড়কে মূল্যবান প্রাণের বেঘোরে মৃত্যু। অমার্জনীয় অবহেলায় ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু, ফ্লাইওভারে, মেট্রোরেলসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরের দৃশ্যমান মেগা প্রকল্পের কাজের মহা প্রলয়ের তাণ্ডবে ওপরে তাকালে এখন কোথাও কোথাও আর আকাশ দেখা যায় না। গগণচুম্বী উন্নয়নের ধাবমান আগ্রাসনে প্রতিদিন চুরি হয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ। চোখে পড়ে শুধু ইট, পাথর আর রডের আকাশ। তার নীচে চাপা পড়ে যায় মনুষ্যরূপী ঠুনকো জীবন গুলো। উন্নয়নের এই দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়? যে দেশে মৃতরা শুধু সংখ্যা হয়ে যায়! বিপর্যস্ত জনজীবনে প্রশান্তির বার্তা দিতে এখনই নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। চাই দীর্ঘমেয়াদি সঠিক এবং কার্যকর পরিকল্পনাও।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।