বাঙালির বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক সাধনার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান শান্তিনিকেতন। সেই শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ দিনের লালিত শিক্ষা চিন্তার আলোকে ১৯২১ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর নামকরণ করেন বিশ্বভারতী। বিশ্বে অবাধ ও মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র হিসাবে একে গড়ে তোলার জন্য তিনি আত্মনিয়োগ করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোতে উৎকীর্ণ করা হয় একটি ঔপনিষদিক উক্তি– “যত্রং বিশ্বং ভবত্যেকং নীড়ম”–বিশ্বের সব জ্ঞান ও ভাবনার নীড় বা আশ্রয় স্থল হবে বিশ্ব ভারতী। বিশ্বভারতী বিশেষ কোন ধর্মের আচার সর্বস্বতায় আবিল হবে না। সব ভাষা ও ধর্মের অনুসারীদের মিলিত চিন্তা–ভাবনায়, পঠন–পাঠনে বিশ্বরূপ ধারণ করবে বিশ্ব ভারতী। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে দেশ–বিদেশের পন্ডিতগণ সেদিন ছুটে এসেছিলেন প্রত্যন্ত বাংলার রুক্ষ লাল মাটির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ শান্তি নিকেতনে। বারানসী থেকে তিনি সেই সূত্রে আহ্বান জানালেন সেদিনের ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতি বিষয়ক পন্ডিত, সংস্কৃত ভাষার খ্যাতিমান শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেনকে। প্রথমে রাজি না হলেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বারংবার অনুরোধে তিনি সেই ১৯২১ সালেই চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। এসেই তিনি মুগ্ধ হলেন এর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ দেখে। লেগে গেলেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী, সহমর্মী হিসাবে বিশ্বভারতীকে গড়ে তোলার কাজে। ঢাকার বিক্রমপুরের অধিবাসী ক্ষিতিমোহন সেন সপরিবারে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর কন্যা অনিমা সেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহাচর্যে বড় হয়ে উঠেন একজন বিদূষী নৃত্য শিল্পী হিসাবে। পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল পল্লী ও মুসলিম অধিবাসীরা নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিল এ প্রাঙ্গনের সাথে। পাশেই উন্মুক্ত প্রান্তরে ফি বছর অনুষ্ঠিত হত পৌষ মেলা। আমি নিজে চারবার গেছি শান্তিনিকেতনে নিছক তীর্থযাত্রার আকুতিতে। ঘুরে বেড়িয়েছি উত্তরায়ণ, শ্যামলী, উদীচী সহ রবীন্দ্র বাসভবন গুলোতে, রবীন্দ্রভবনে– শ্রীনিকেতনে। কিন্তু সেই সাধনার সেই আরাধনার যজ্ঞশালার দুয়ার আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে বিজেপির গৈরিকায়নের ধর্মান্ধ আঘাতে। আজ মহর্ষির স্মৃতিধন্য পৌষ মেলা বন্ধ, রবীন্দ্র বাসভবন গুলোতে এখন কারো প্রবেশাধিকার নেই, বসন্তউৎসব, বর্ষামঙ্গলসহ ষড় ঋতুর উৎসবগুলো আজ বন্ধ, দরিদ্র সাঁওতালদের নিত্যদিনের জ্বালানির উৎস বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ঝরা পাতা সংগ্রহ বন্ধ, বিরুদ্ধ মতাবলম্বী শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নিয়ত নিগৃহীত। বিশ্ব ভারতীতে শুরু হয়েছে আজ রবীন্দ্রনাথের অপছন্দের পৌত্তলিকতা ও সন্ন্যাসী বন্দনা। আচার্য মোদির নিযুক্ত উপাচার্য বিদ্যুত চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের প্রাণের প্রতিষ্ঠানকে রবীন্দ্র ভাবাদর্শ শূন্য করার সংকল্প নিয়ে দিল্লী থেকে এসে আজ পুরো বিশ্বভারতীর প্রাণ সংহার করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আজ বিপর্যস্ত বিশ্বভারতী, বিপন্ন প্রায় এর সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যিক পরম্পরা।
প্রাচ্য বিশারদ অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনকে ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ১.৩৮ বিঘা জমির উপরে ‘প্রতীচী’ নামের রবীন্দ্র পদস্পর্শ ধন্য বাড়ীটি তৈরি করেছিলেন পরবর্তীতে তাঁর কন্যা অমিতা সেনের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক অধ্যাপক আশুতোষ সেন। তাঁদের ঘরে জন্ম নেন এক পুত্র সন্তান। আদর করে রবীন্দ্রনাথ ঐ ছেলের নাম দেন অর্মত্য। ঠাট্টাচ্ছলে অমিতা সেনকে বলেছিলেন “দেখিস য–ফলাটা যেন বাদ না পড়ে।” কিন্তু অমর্ত্য নিজে অ টা বাদ দিয়ে মর্ত্যের মানুষ হয়েছেন জীবনে মননে।
অমর্ত্য সেন প্রায় পুরো জীবন রবীন্দ্রনাথের মানবিক ও উদার জীবনভাবনা লালন করেছেন মনে–মননে ও কর্মে। ’৪৩ এর বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ’৪৬ এর কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর এপার–ওপার, ঢাকা বিশা্ববিদ্যালয় ছেড়ে তাঁর পিতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশত্যাগ এসব ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন– কৈশোরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। কিন্তু তিনি এসবের মূল কারণ হিসাবে দেখেছেন ঔপনিবেশিক শাসকদের বিভেদ ওর্ শাসনের ধূর্ত কৌশল হিসাবে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী উপজাত হিসাবে নিছক কোন সাম্প্রদায়িক নেতার ইচ্ছার পরিণাম হিসাবে শুধু নয়। সাম্প্রদায়িকতা, ধনবৈষম্য, পশ্চাদপদ ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিপরীতে উদার কল্যাণকামী আর্থ–সামাজিক নীতি ব্যবস্থার পক্ষে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন পরম নিষ্ঠায়। আবার রবীন্দ্রনাথের মত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সামষ্টিক কল্যাণের নামে ব্যষ্টিক নিপীড়ন কখনো যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। শুধু অর্থনীতি নয়, জীবন ও জগত নিয়ে এক বাস্তব দার্শনিক বিশ্ববীক্ষার অধিকারী ছিলেন প্রফেসর সেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের আলোকে তাঁর আত্মজীবনীর নাম রেখেছেন “Home in the world”। কেম্ব্রিজের মাস্টার অব ট্রিনিটি, এমআইটির শিক্ষক, হাভার্ডের দর্শন ও অর্থনীতির খ্যাতিমান শিক্ষক প্রফেসর সেন আজীবন মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের তীব্র বিরোধী ছিলেন। কল্যাণমূলক, যতদূর সম্ভব বৈষম্যহীন রাজনৈতিক অর্থনীতির উপর ভেবেছেন, লিখেছেন এবং কাজ করেছেন। কারণ বের করেছেন বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষগুলোর, অর্থনীতিকে গাণিতিক ব্যাখ্যার ঘেরাটোপ থেকে বের করে মানবিক করতে চেয়েছেন কিন্তু নিজে ছিলেন গাণিতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ। চিরায়ত অর্থনীতির বদলে তাঁর মানবিক ও কল্যাণধর্মী অর্থনৈতিক গবেষণা ও প্রকাশনা সাড়া ফেলে পৃথিবীর সর্বত্র। অনেক দেরীতে হলেও অবশেষে ১৯৯৮ সালে নোবেল কমিটি তাঁকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার সে বছর তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ পদক ভারতরত্নে ভূষিত করে।
অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ ছাড়াও “The Argumentative Indians” “The Idea of Justice”, “Ethics and Economics” ইত্যাদি গ্রন্থকে বলা যায় তাঁর দার্শনিক চিন্তার আকর। বহুমত ও ধর্মের সহাবস্থান, ভারতের আবহমান কালের “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য”, মুক্ত সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি ও জিজ্ঞাসা ছিল তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রধান অন্বিষ্ট। তিনি মানুষকে কোন ধর্মের বেড়াজালে বিচারের বিভক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন আজীবন। বস্তুত তিনি একজন প্রত্যয়ী নিরীশ্বরবাদী।
আজকের পৃথিবীতে অমর্ত্য সেন হলেন প্রবীণতম একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক, কল্যাণকামী অর্থনীতিবিদ, বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক ও উদার মানবতাবাদী এক মহা মনীষী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথা শাসিত ধর্মীয় বিধানের শাসন থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে ছিল ইউরোপীয় এনলাইটেন্টমেন্ট। অমর্ত্যসেন সেই ইউরোপীয় এনলাইটেন্টমেন্টের সার্থক উত্তর পুরুষ– ধর্মান্ধতা, বৈষম্য ও বিভেদের রাজনীতি ও অর্থনীতির বিপরীতে এক বলিষ্ঠ প্রতিস্পর্ধী স্বর। সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসার মাধ্যমে উগ্র ধর্মান্ধ বিজেপি হিন্দুত্ববাদী ধ্বজা তুলে যখন গুজরাট দাঙ্গার রূপকার মোদিকে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করে তখনই অমর্ত্য সেন নৈতিক তাগিদে ভারতবাসীকে এই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ভোট না দিতে অনুরোধ করেছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তিনি নীতিগতভাবে নরেন্দ্র মোদি সরকারের দুঃশাসনের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন– ধর্মের নামে বিজেপির লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন ভারতবাসীর কাছে। কেননা তাঁর জীবন দর্শন কখনো রাজনীতির ভাবনা বিবর্জিত ছিল না।
মোদি ক্ষমতায় এসেই বিশ্বনন্দিত এই মনীষী দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদকে নিয়ে নানা কুৎসা শুরু করেন। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হলেন নরেন্দ্র মোদি। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শ্রী সেনের পৈত্রিক বাড়ীটি নিয়ে প্রায় ১০০ বছর পরে বিজেপি নিযুক্ত উপাচার্য, কট্টর বিজেপি সমর্থক দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত অধ্যাপক বিদ্যুত চক্রবর্তী আপত্তিকর কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাবীন্দ্রিক ভাবাদর্শ, উদার উন্মুক্ত পরিবেশ, পৌত্তলিকতা বিরোধী সমন্বয়ী আধ্যাত্মিক পরিবেশকেও তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেননি।
পশ্চিম বঙ্গের বিজেপির বিভেদাত্মক হিংসার রাজনীতির ও নির্বাচনী বিজয়ের পথে স্বাভাবিকভাবেই প্রধান বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধক হলেন অমর্ত্য সেন। ধর্মান্ধতা ও গৈরিকায়নের মাধ্যমে বিশ্ব ভারতীকে উদার ও অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্র ভাবাদর্শচ্যুত করার চলমান প্রক্রিয়ায়ও তিনি বিরাট বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন। ইতোপূর্বে বিশ্বভারতীয় প্রগতিশীল শিক্ষকদের অনেককেই উপাচার্য বিদ্যুত বাবু বরখাস্ত করেছেন, প্রগতিশীল পড়ুয়াদের সাথে তাঁর সংঘাত লেগেই আছে। এখন তিনি মোদি–অমিতের নির্দেশে প্রফেসর অমর্ত্য সেনের সম্মানহানি ও তাঁকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এই ৮৯ বছর বয়সে তাঁকে নোটিশ দিয়ে ১৯২৩ সালে তাঁর মাতামহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত ১.৩৮ বিঘার জমি থেকে “দখলকৃত(?)” ১৯ শতক জমি ছেড়ে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে চলছে চাপানউতোর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডে ক্ষিতিমোহনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ১.৩৮ বিঘারই দলিলপত্র পাওয়া গেছে যা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে এসেছেন। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙ্গে অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি বিশ্ব ভারতী কর্তৃপক্ষকে আইনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। উপাচার্য ইতোমধ্যে জনসমক্ষে তাঁকে নিয়ে কটু মন্তব্য করে চলেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ এ নিয়ে প্রতিবাদে প্রতিরোধে এগিয়ে এলেন না। কথিত সুশীল সমাজ, কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নীরব ভূমিকায়। এতে বোঝা যায় সমাজে গৈরিকায়নের প্রভাব ও পচন কত গভীরে পৌঁছেছে। অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে বিজেপির এই লাগাতার আক্রমণ মূলত ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক। এ আক্রমণ মূলতঃ প্রবল হিন্দুত্ববাদ বিরোধী রবীন্দ্র ভাবাদর্শ ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতী ও আজকের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী মনীষী অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক ইতি কর্তব্য এদেশে আমাদেরও আছে বৈকি। কেননা সবদিক থেকে তিনি আমাদের লোক। রবীন্দ্র ভাবাদর্শ আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য পাথেয়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট