বিপন্ন সমাজ দর্শনে একমুঠো আলোর দুনিয়া

রিজোয়ান মাহমুদ

| শুক্রবার , ২৮ জুন, ২০২৪ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

অভীক ওসমান, গত শতাব্দীর শেষ সত্তরের উজ্জ্বল মেধাবী এক কবির নাম। কবিতা নিয়ে জীবনবোধ ও জীবনের আঁটঘাট চেনার সুযোগ হলেও তিনি স্বেচ্ছায় কবিতা থেকে নির্বাসিত। মধ্য সত্তর থেকে এখনও অবধি তিনি সৃষ্টিশীল সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নিজের কবি পরিচয় গোপন কুঠুরিতে রেখে দিলেও তিনি আমূল ধীসম্পন্ন অনুভূতিপ্রবণ এক কবি। নিজেকে ভাবেন প্রাবন্ধিক নাট্যকার এবং পদ্যকার। ফলস্বরূপ, ২০২৩ সালে খড়িমাটি থেকে তিনটি গ্রন্থ যথাক্রমে বিষাদের জার্নাল, হে সংসার হে লতা এবং শুধু তোমার জন্যে এই অরণ্য আর অগ্রন্থিত কিছু লেখা এক মলাটবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয় নির্বাচিত পদ্য। নিজেকে পদ্যকাররূপে চাওয়া কোনো গূঢ় অভিমান থেকে অভিসিক্ত করেন ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট না হলেও পাঠকের রায়ে এবং অন্তর্নিবিষ্ট সৌন্দর্যের পরাগায়নে তিনি আপাদমস্তক কবি। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ভারতবর্ষের ডাকসাইটে সবচেয়ে আলোচিত বাংলা ভাষার শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। এটি কি সেই অনুসরণিকা? অভীক ওসমানের শব্দের সৌন্দর্য মেঘের মতো সুন্দর। বিষয়ে বিবিধার্থ লতিয়ে ওঠা মুহুর্তের নির্যাসমিশ্রিত স্পন্দন। অকাতরে শব্দের গোলাপ বিক্রি করে তিনি তরুণ তরুণী থেকে রাস্তার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী। কবিতা, আপাতত বাদ রেখে তিনি নাটক, নাট্যতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা এবং রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ ও লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বলাবাহুল্য হবে না সব পথেই তিনি স্বচ্ছন্দ অনায়াসসিদ্ধ। অর্থাৎ শিল্পের সব শাখাতে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। কবিতা যারা লেখে এবং অবিরাম লিখে চলেছে তারা নিজেদের কবি পরিচয়কে মহান করে তোলার কসরত চাক্ষুষ করেছি। অন্যের মুখে কবি সম্বোধন না শুনতে পেলে তীব্র অভিমান করে, মনে গুরুতর রাগ পোষেনকেন কবি বলা হলো না! কবিতা হোক বা না হোক কব্জি ডুবিয়ে বলতে হবেকবি। অভীক ওসমান, সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম। কোনো মঞ্চে বা কোনো আড্ডায় কেউ তাঁকে কবি সম্বোধন করলে তিনি বিনয়ের সাথে কবি না বলার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। তাঁর ধারণা ফটাফট কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কবি হওয়া যায় না। কবির ব্যপ্তি অনুভূতির দহনের চাইতেও বড়। কবিতা কখনোসখনো দর্শনের সমান যৌক্তিক, যদিও বেশিরভাগই এস্থেটিক বা সৌন্দর্য দর্শনে বশীভূত। কবি যদি উত্তরাধিকারের স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতা সমাজদর্শনের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে দাঁড় করাতে না পারেন কিংবা যদি হরহামেশা প্রেমের পাঁচালিতে অনুবদ্ধ থাকেন তো সংকট সম্মুখে চলে আসে। অভীক ওসমান কি শুধু প্রেমের পাঁচালি করেছেন, মনে হয় না। তাঁর তিনটি কবিতাগ্রন্থ এবং অগ্রন্থিত কবিতা সে সাক্ষ্য দেয় না অন্তত। অভীক ওসমানের চিন্তার ওজনে প্রেম, দ্রোহ, রাজনীতি ও খেটেখাওয়া নিম্নবর্গের মানুষের নির্মাণ আধিক্য দেখা যায়। শব্দের ঢেউ দগদগে অতলান্ত। তিনি যে এত বছর সমুদ্র পাড়ের নুড়ি নিয়ে শব্দ খেলায় মেতে ছিলেন ঢেউয়ের সাথেসেসব কথিত অনুষঙ্গ কি তাঁর কবিতায় কোথাও ছিল না! কবিতায় তিনি সরাসরি ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন। ইতিহাস ঐতিহ্যের বিষয়ানুষঙ্গ সরল সোজা ভাষিক চেতনায় প্রকাশ করেন। সমকালের অনুজ্জ্বল অসাম্য তাঁকে বিপর্যস্ত করেছে বারবার। উপরের ধোপদুরস্ত ঋজু ব্যক্তিত্ব ও ভেতরের অভীক ওসমানের ক্ষরণ টের পাওয়া যায় গভীর সন্তর্পণে। সমাজ রাষ্ট্রের বেপরোয়া অনিয়ম, গণতন্ত্রহীনতা, ধনী গরীবের ভেদাভেদ বেড়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদের অর্থলুন্ঠন, সেই সাথে গুমখুন বিচারহীন হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যাওয়াকে তিনি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। স্বাধীনতা ও মানচিত্রের অসম্মান তাঁকে বিঁধেছিল গোড়া থেকে। তিনি একজন কঠিন ঋজু ব্যক্তিত্বের মানুষ। আপস করা তার রক্তে নেই। ৩০ লক্ষ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে দেশী হায়েনাদুর্বৃত্তদের দখলে যাবে, সেটি মানা তার পক্ষে কঠিন। সামাজিক বৈষম্য অব্যবস্থাপনা অনৈতিক সুবিধাবাদ তাঁকে ভীষণ পীড়া দেয়। তাঁর আরাধ্য বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। এবং রুচিসম্মত রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিতকরণ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে কোনো নেতাকে এতটা ভাবতে দেখি নি। অথচ অভীক ওসমান, নিরন্তর সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে থাকেন বিধায় তাঁর ইতিহাস ও স্বদেশচিন্তা গভীর ভাবনাপ্রসূত। এক কথায় বলতে গেলে তাঁর ভাবনার জায়গা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার। মহাত্মা গান্ধী ভারতবর্ষে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে তরবারি উঁচু না করে সৃজনশীলতাকে প্রকৃত অস্ত্র মেনেছেন। তাই তিনি সারা ভারতবর্ষে অহিংস আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে পেরেছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির দর্শন ও শক্তির কথা। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউজ উইকের সাংবাদিক লোবেন জেঙ্কিন্স তার প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটিই বিজ্ঞ ও গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সৃজনশীলতা। গোড়া থেকেই বঙ্গবন্ধু আপসের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন। তেমনি করে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, চিলির সালভাদর আয়েন্দে এঁদের মধ্যে সাহিত্যজ্ঞান ছিল প্রচণ্ড রকমের। মিখাইল গর্বাচভ ছিলেন সামাজিক গণতন্ত্রী এবং সৃজনশীল ইনোভেটিভ টেন্ডেন্সি তাঁর লক্ষ্য ছিলো। অভীক ওসমানের মধ্যে সৎ ও সুন্দর মানুষ হয়ে উঠার একাগ্রতা ও সৃজনশীলতা লক্ষ্য করেছি। লক্ষ্য করেছি, স্বাধীনতা উত্তর অসাম্প্রদায়িক সৃজনশীল সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক, এমনতর ভাবনা ও দর্শন। বাংলাদেশের খুব স্বল্প সংখ্যক নেতার মধ্যে সাহিত্যে গুণাবলী দেখেছি। অনেকেই কাঠখোট্টা প্রচলিত পুরনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে শেষ করে সভা। আমাদের দুর্ভাগ্য সাহিত্যবোধ সম্পন্ন নেতা খুব একটা পাইনি। অভীক ওসমান সে জায়গায় ব্যতিক্রম। যে সমাজ দর্শন ও পরিবর্তনের ধারা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সে সমাজে গুণগত পরিবর্তন আসেনি অধিকন্তু, দলের রূপ পরিবর্তিত হয়েছে নেতৃত্বের সংঘাতে বারংবার। চতুর্ভাগে বিভক্ত একটা রাজনৈতিক দলের ভগ্নাংশ নিয়ে তিনি পড়ে রয়েছেন একটানা বিগত পাঁচ দশক ধরে। সুযোগ থাকলেও পরিবর্তন করার চিন্তা মাথায় কখনো আসেনি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাঁর মেধা ও মননে এক ঘোর তৈরি করে রেখেছে। আমার কাছে তাঁকে মনে হয় বিদ্যাবুদ্ধিতে তিনি প্রাইভেট মার্ক্সসিস্ট। একটা সীমিত সম্ভাবনায়ময় দলে সংশ্লিষ্ট থাকা তিনি ঘরকুনো বাঙালির স্বপ্ন ও দর্শনের নিয়ামক।

সত্তর দশকে ছাত্র রাজনীতি যখন তুঙ্গে অবস্থান করছে, তিনি তখন তুখোড় রাজনৈতিক কর্মী। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, রাজনীতি ও সৃজন ক্ষমতাকে তিনি নিজের মতো ব্লেন্ডিং করে ভিন্নরূপে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের নাট্যগোষ্ঠী গণায়নএর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাট্যকার। কয়েকটি নাটক সেসময়ে মঞ্চায়িত হ’য়ে প্রত্যেক নাট্যমোদির অন্তরে সাড়া জাগিয়েছিল। এক: তিরোহিত সুন্দর আমার ১৯৭৫, রাতফেরার ১৯৭৮, অবশেষে জেনারেল ১৯৮৬, শঙ্খ উপাখ্যান ১৯৮৯। মূলত অভীক ওসমান একজন শেকড় সন্ধানী লেখক। চিরায়ত বাঙালির গায়ের গন্ধ কোথায় লুকিয়ে থাকে, কোত্থেকে সুঘ্রাণ ছড়াবে; অভীক ওসমানের নির্ভার প্রাণোচ্ছল নিরুদ্ববিগ্ন গদ্যে দৃষ্ট হয় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। ব্যক্তি অভীক ওসমান সজ্জন সদালাপী ও বন্ধুবৎসল কিন্তু রাশভারী অভিজাত। লেখক অভীক পাঠকের কাছের জন, মাটি ও মানুষের সৃজনমুখর গল্প। শক্তিশালী নাট্য রচনা ও বুদ্ধিদীপ্ত বাগ্মিতার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অতিথি শিক্ষক। অবসরপ্রাপ্ত উঁচুমানের কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব। নিজের প্রায় ১১ টি মৌলিক গ্রন্থ ছাড়াও সমৃদ্ধ গবেষণা ও সম্পাদিত ৪ টি গ্রন্থ সুধীমহলের নজর কেড়েছে। বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল ঘনঘটা ও জীবন যাপন কবি অভীক ওসমানেরকোনটা রেখে কোনটা ছোঁবোসবকিছুকে ছাড়িয়ে আমার তাঁকে মনে হয় আপাদমস্তক একজন অন্তর্ভেদী কবি। সর্বাঙ্গে বিষাদের জার্নাল। মঞ্চে তিনি কবিতা আলোচনায় প্রাণবন্ত ও যৌক্তিক। তরুণ কবি লেখকদের লেখা অনবদ্য ব্যবচ্ছেদ করেন। তাঁর সময়জ্ঞান ও বিষয়জ্ঞান অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। ঘাটে যে নৌকা বাঁধা তাতে আছে তা মানবিক সংবেদনশীল মানুষের নিঃশ্বাস । তিনি কবি বিপন্ন সমাজ মানসের। সর্বোপরি, অভীক ওসমান বিপন্ন সমাজ দর্শনে একমুঠো আলোর দুনিয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজিত জ্যোৎস্নার দাহ
পরবর্তী নিবন্ধসাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো আরেকটা চালাকি : ফখরুল