বিপন্ন বনরুই কালোবাজারে দাম ২ লাখ টাকা

পাচার হয় চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়

কক্সবাজার প্রতিনিধি | সোমবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকা সংলগ্ন তৃণভূমিতে একসময় ব্যাপক সংখ্যায় দেখা যেত কয়েক প্রজাতির বনরুই বা খুদুক। কিন্তু এর মাংস ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মূল্যবান হওয়ায় সাম্প্রতিককালে পাচারকারীদের টার্গেটে পড়ে প্রাণিটি এখন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে প্রকৃতিতে কম দেখা গেলেও মাঝেমধ্যেই পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার হয় বনরুই। কালোবাজারে একটি বনরুই এর দাম প্রায় ২ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। গত শুক্রবার কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া থেকে একটি ‘দেশী বনরুই’ উদ্ধার করা হয়েছে। বনরুইটি ‘ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন’ বা ‘দেশী বনরুই’ প্রজাতির বলে শনাক্ত করা হয়েছে, যেটি স্থানীয়ভাবে ‘খুদুক’ নামে পরিচিত। প্রায় চার মাস আগেও একই এলাকা থেকে একটি বনরুই উদ্ধার করেছিল বনবিভাগ। একজন প্রতিবন্ধী লোক দিয়ে বনরুইটি বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় বনকর্মীদের হাতে ধরা পড়ে। এর আগে ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৯টি বনরুই উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। তখন পাচারকারী চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। ওই সময় এক অভিযানের পর র‌্যাব জানিয়েছিল, একটি বনরুই দুই লাখ টাকায় বিক্রি করে পাচারকারীরা। একটি চক্র দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন প্রাণী সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে।

চলতি বছর ভারতের উড়িষ্যা, আসাম ও অরুণাচলসহ বিভিন্ন স্থান থেকেও এই জাতের বনরুই উদ্ধারের খবর পাওয়া যায় গণমাধ্যম থেকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মুম্বাইয়ে পুলিশের অভিযানে বনরুই এর ৩০ কেজি চামড়া উদ্ধার করা হয়। যার মূল্য ৩০ লাখ রুপি বলে উল্লেখ করা হয় ইন্ডিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ভারতে ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জীবিত ও মৃত মিলে মোট ১২০৩টি বনরুই উদ্ধার হয়েছে।

বনরুই আঁঁশযুক্ত পিঁপড়াভোজী প্রাণী। ফোলিডোটা বর্গের যে আট প্রজাতির বর্মঢাকা, দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে, বনরুই তার মধ্যে একটি। এশিয়া মহাদেশ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায় এদের। পৃথিবীতে ৮ প্রজাতির বনরুই রয়েছে, তার মধ্যে এশিয়ায় আছে ৪ প্রজাতির। এশীয় বনরুইদের ৩টি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এশিয়ার চারটি প্রজাতিকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ম্যানিস ক্র্যাসিকোডাটা বা দেশী বনরুই ও ফিলিপাইনের ম্যানিস কিওলায়নেন্সিসকে বিপন্ন এবং সুন্দার ম্যানিস জাভানিকা ও চীনা একটি প্রজাতিকে অতি বিপন্ন হিসাবে দেখানো হয়েছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা অসিম মল্লিক জানান, বাংলাদেশের বনরুই পাচার হয়ে যায় চীন, জাপান সিঙ্গাপুর ও মালোয়েশিয়ায়। মূলত এগুলো মাংস হিসেবে চীন ও জাপানে ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া বনরুইয়ের খোলসের আঁশ নামি দামি ব্র্যান্ডের জামাকাপড়ের বোতাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কখনও কখনও গহনা হিসেবেও এর আশ ব্যবহার হয়ে থাকে। এজন্যই মূলত চড়া দামে বিক্রি হয় বনরুই।

বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণি পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’র সূত্রমতে, ২০১০২০১৫ সালের মধ্যে বনরুই পাচারে ব্যবহৃত মোট ১৫৯টি রুট পাওয়া গেছে। বনরুইয়ের এক কেজি মাংস ৩৫০৫০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। চায়না এবং ভিয়েতনামে এর প্রচুর চাহিদা। প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণি হচ্ছে বনরুই। এশিয়ায় এ প্রজাতি বর্তমানে অতি মহাবিপন্ন।

বনরুইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ পাঙ্গোলিন মালয় ভাষা থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ঘূর্ণায়মান বস্তু, যা আত্মরক্ষার সময় প্রাণীটির নিজেকে বলের মতো কুঁকড়ে ফেলার অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে। সাধারণত প্রাণী হিসেবে বনরুই খুবই ভীতুস্বভাবের। এদের গড় আয়ু নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে বন্দী অবস্থায় পর্যবেক্ষণকালে তাদের ২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে দেখা গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনুমতি ছাড়া চা পাতা মজুদ ওয়্যারহাউজের ৩ গোডাউন বন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধজেগে উঠুন, সরকারকে পরাজিত করুন ফখরুল