বিনুনী ফাঁদে কেউই বাঁধা পড়লো না!

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ৩১ মে, ২০২৫ at ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

বিদ্রোহ আর প্রেমের কবি নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “সই, ভালো করে বিনোদ বেনী বাঁধিয়া দেমোর বধূ যেনো বাঁধা থাকে, বিনুনী ফাঁদে”এই ধরনের আকুতির পরেও তাঁর স্বপ্নের নায়িকাদের কাউকেও তিনি এই বিনোদ বেনীর ফাঁদে বাঁধতে পারেননি। কারণ এমন রোমান্টিক, এমনই প্রেমিক, আবার ক্ষ্যাপা অথচ প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব, যার শিরা উপশিরায় রয়েছে বিদ্রোহের রক্তকণিকা। কাজেই কোমলমতি আর প্রেমের কাঙ্গাল নারীরা তো কোনোভাবেই তাঁকে তো বাস্তব জীবনে কেউই বাঁধতে পারেনি, কবিও জীবনের যাবতীয় প্রেমসুধা দিয়ে কোনো স্বপ্নের নায়িকাকে ভালোবাসার বাহুডোরে চিরকালের জন্য বন্দী করতে পারেননি। শিশুকালে মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলেই মা এবং নারীজাতির প্রতি বিশেষ করে মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতি কবির চেতনায় ও মননে এক ধরনের সন্দেহ ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত হয়। বঞ্চনা, নিপীড়ন আর দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত কবি তখন হাতে নেন দ্রোহের অগ্নিবীণা। কিন্তু তাঁর মনোজগতেও রয়েছে প্রেমের উত্তাল তরঙ্গমালা। ফলে ‘বল বীর, বল, চির উন্নত মম শির’ বলে দেশ কাঁপানো ডাক দিয়েও দ্রোহের অগ্নিবীণা হাতে নিয়েও তিনি আবার বলেছিলেন, ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে/ আকাশ কাঁদে তারার আলোয় গানের ভোরে…’। আমরা জানি কবি নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে বিশ্বখ্যাত। কিন্তু তাঁর বিদ্রোহী সত্তার অন্তরালে ছিল বিস্ময়কর এবং প্রচন্ড এক প্রেমিক সত্তা।

এই কারণেই সমালোচকরা বলেছিলেন, কবি নজরুলের এক হাত গণ মানুষের প্রতি, অন্য হাত মনোমানুষের প্রতি। কবির দ্রোহ চেতনার সাথেই ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত কবির প্রেমিক সত্তা। তবে প্রেম যে চিরন্তন, তিনি তা মনেপ্র্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি তাই লিখেছিলেন, “প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র, সে তো চিরন্তন নয়।” এই ভাবনার অবশ্য যথেষ্ট কারণও ছিল। কবিমন, প্রেমিক মন, চেতনা একেবারেই টইটুম্বুর প্রেমের। যাকেই মনে ধরছে, তাকেই প্রেম নিবেদন করছেন, নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন, কবিতা লিখছেন, গান লিখছেন। কিন্তু যাদেরকে তিনি পেতে চেয়েছেন একান্তে, গভীর ভালোবাসায়, তাদের কাছ থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বারেবারেই। ফলে শৈশবে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত দারিদ্র জর্জরিত সময়ের নামের “দুখু মিয়া” আজীবনই দুখুই রয়ে গেলেন, চিত্তে আর বিত্তে। কবির জীবনে প্রেম বারেবারে নানা বর্ণে, নানা শিহরণে, বিচিত্র ছন্দে আসলেও আমরা জানি কবির জীবনে তিনজন নারীর প্রভাব ছিল প্রচন্ড হৃদয় নিংড়ানো। নার্গিস,ফজিলাতুন্নেছা ও আশালতা। কবির সমগ্র সৃষ্টিতে রোমান্টিসিজম এর মূলে রয়েছে এই তিন জন নারীর প্রতি কবির একেবারে নির্ভেজাল প্রেমচেতনা। নার্গিসের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই একের পর এক গান আর কবিতা লিখেছিলেন। আবার প্রচন্ড জেদ, অভিমান আর ব্যক্তিত্বের তাড়নায় তিনি একেবারেই বিনা অপরাধেই কিশোরী নার্গিসকে ত্যাগ করে বিয়ের রাতেই পালিয়ে এসেছিলেন। জানি না এই কিশোরী এমন নির্মম প্রত্যাখ্যান কিভাবে সহ্য করেছিলেন। সেদিন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কবির সমস্ত সৃষ্টি জুড়েই নার্গিস ছিল সদা বিরাজমান। আর ফজিলাতুন্নেছা প্রথম মুসলিম নারী, যিনি গণিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি সমকালীন সময়ে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কবির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। কবি তাঁর প্রতিও অনুরক্ত ছিলেন। সেখানেও তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রমীলার সাথেই কবি গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, বারে বারে হারানো আর না পাওয়ার বেদনাকে সাথী করেই। হারানোদের বিরহ ব্যথায় চরমভাবে আক্রান্ত হয়ে তিনি লিখে গেছেন একের পর এক গান, কবিতা,গল্প, উপন্যাস। প্রতিটি গান আর কবিতার বাণীতে ভালোবাসার নারীদের না পাওয়ার আর্তনাদ মিশে রয়েছে পরতেপরতে, সুরে আর বাণীতে। এই যে শুরুতেই বলেছিলাম, শক্ত বিনোদবেনী বেঁধে দেয়ার কথা! সেই বেনীর বিনুনী শক্ত ছিল না। তাই কবির ভালোবাসার বিনুনী খুলে গিয়েছিল বারবার। তিনি লিখেছিলেন, “আবার ভালোবাসার সাধ জাগে, সেই পুরাতন চাঁদ, আমার চোখে আজ নূতন লাগে।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার অবসান হোক
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মা সমাবেশ