বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করুন

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা বর্তমানে এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও বিনিয়োগকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। জিডিপিতে ৩৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখা শিল্পখাত এখন গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুখে। মাত্র এক বছরে গ্যাসের দাম ১৭৮ শতাংশ এবং সম্প্রতি আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে টেক্সাটাইল, স্টীল ও সারের মতো প্রধান শিল্পগুলোর উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে এসএমই খাত কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কষঘাতে জর্জরিত স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তাদের টিকে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) খাতের উদ্যোক্তারা কঠিন সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার পরিবর্তন হলেও ব্যাংকঋণের সুদের হার কমেনি। এসএমই খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে এ খাতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পুঁজির সংকট প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব ও বিনিয়োগে ঘাটতি। রপ্তানি বাজারে অনুপ্রবেশের অক্ষমতা, চাহিদামতো নীতিসহায়তা না থাকায় এসএমই খাতের সংকট কাটছে না। যা কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসায়ীদের মতে, শিল্পোয়নের অভাবে এরই মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে যা দেশে ক্রমবর্ধমান সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত পিপিআরসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে গত ৩ বছরে বেড়েছে দেশের দারিদ্র্য হার। ২০২২ সালের বিবিএসের হিসাবে দেশে অতি দারিদ্র্য ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সেটি ২০২৫ সালে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া সাধারণ দারিদ্র হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মাসিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় ধারদেনা করে চলছে সংসার। একটি পরিবারের খাবার কিনতে ব্যয় করতে হবে সেই আয়ের ৫৫ শতাংশ। পরিবারের আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে সবেচেয়ে বেশি চিকিৎসা ব্যয় ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ঋণ পরিশোধে ব্যয় ২৭ শতাংশ। বেড়েছে আয় বৈষম্য। শিল্প বিনিয়োগ না হওয়ায় এবং এসএমই খাত সংকটের কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বড় সংকট।

বিশ্ব ব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষায় দেশের মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ বা ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা নয়। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নিয়েও প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ঝুঁকিকে আরও প্রকট করেছে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি। কর্মসংস্থানের অভাব এবং আর বৈষম্যের মতো বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো।

দেশে বর্তমান বিনিয়োগের খরা চলছে। শিল্প খাতে গতি নেই। নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। পুরানো শিল্পগুলোর বেশিরভাগ বেকায়দায় আছে। টিকে থাকার কৌশল হিসেবে অনেকে খরচ কমাতে কর্মকর্তাকর্মচারীশ্রমিক ছাটাইয়ের মতো সহজপথ বেছে নিয়েছে। সরকারি খাতেও নতুন কর্মসংস্থানের খোঁজ নেই। ব্যাংকিং খাতে নৈরজ্যমূলক অবস্থায় কয়েক হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সববিছু মিলিয়ে দেশে কর্মসংস্থানের গতি নেই। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। যা সমগ্র অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও শিল্প খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

গত এক বছরে বিগত সরকারের সময়ের প্রভাবশালীদের বড় মাপের শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কাজ হারিয়েছেন কয়েক লাখেরও বেশি শ্রমিককর্মচারীকর্মকর্তা, অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়ে এসব কারখানার মালিকদের অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরইমধ্যে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে আছেন। সরকারি উদ্যোগে এসব কারখানাগুলোর অনেকগুলো প্রশাসক নিয়োগ করে চালানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ফলপ্রসু কোন উন্নতি চোখে পড়ছে না। বিশেষজ্ঞমহলের মতে, অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ প্রশাসক নিয়োগের ফলে এ সমস্যা আরো প্রকটতর হয়েছে। ফলে বেশির ভাগ কারখানা গতিশীল হয়নি। বাকিগুলো কবে চালু হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।

প্রভাশালীদের কারখানায় কাজ হারানো, শ্রমিককর্মকর্তাকর্মচারীরা আবার কবে কাজে ফিরবেন তার সময়সীমা জানাতে পারেনি কেউ। নতুন কোন কারখানা তৈরি না হওয়ায় নতুনভাবে চাকরির সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থনীতির বিশ্লেষক ও শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা বলেন, বেকার জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে এখনই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান দুই জায়গাতেই গুরুত্ব দিতে হবে জরুরিভাবে।

বিনিয়োগ পরিবেশকে সংকটের মুখে ফেলেছে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ আমলা শ্রেণি, তাদের অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে বিনিয়োগের পরিবেশ বার বার মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে নতুন বিনিয়োগে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাবে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খরা দেখা দিয়েছে। নতুন বিনিয়োগকৃত কারখানায় গ্যাস সংযোগ পাবে এ ধরনের নিশ্চয়তা কোনভাবেই পাওয়া যাচ্ছে না। বছরের পর বছর গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি অনেক কারখানা। ফলে নতুনরা বিনিয়োগে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। দেশীয় গ্যাসের মজুত হ্রাস হওয়া সত্ত্বেও অনুসন্ধান কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। শুধু সেমিনার ও আলোচনার মাঝে সময় পার করে চলছে। ২০৩০ সালের পর দেশীয় গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসার পূর্বাভাস সত্ত্বেও অপশোরঅনশোরে গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ফলে দেশকে আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে, যার কারণে জ্বালানি উচ্চ মূল্য শিল্পে উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে শিল্প ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে সৌর, বায়ু ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ও সম্প্রসারণ করা জরুরি। জ্বালানি আমদানীর ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হলে ব্যবসায়িক খরচ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে। স্বাভাবিকভাবে এখনই জাতীয় নিরাপত্তা এবং খাদ্য নিরাপত্তার পরই গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় উৎসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। জ্বালানি সংকটের কারণে রপ্তানি খাতের অবস্থান ও টালমাটাল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক ও ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার পোশাকরপ্তানিতে বড় ধরনের সমস্যার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাকরপ্তানিকারক দেশ। দেশের মোট রপ্তানি প্রায় ৮৪ ভাগ জুড়েই রয়েছে আমাদের পোশাকশিল্প বা রেডিমেট গার্মেন্টেস। এ পোশাক শিল্পে কাজ করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। ১৯৮০ সালে মাত্র ১.৮ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি থেকে বেড়ে সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তির এ পোশাকশিল্প বিবিধ কারণে একের পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরের পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় ২৫৮ টি পোশাককারখানা বন্ধ হয়ে গেছে যার ফলে বিপুল সংখ্যক পোশাকশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। দেশের বেকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। চাঁদাবাজী সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে, একথা ভুলে গেলে চলবে না দেশের বিনিয়োগকারী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের হালহাকিকতের দিকে দৃষ্টি রেখে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। কিন্তু চাঁদাবাজ ও মববাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে দেশিয় ব্যবসায়ীরা দিশাহারা। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে আশা করা যায়? প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনকে টেকসই করতে হলে কেবল সাময়িক সহায়তা নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন জরুরি।

সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের মাঝে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আশাকরি সরকার বর্তমান সময়ের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে রাগ অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে নিরপেক্ষভাবে বিনিয়োগের স্বার্থের দিকে নজর দিবেন। অন্যথায় বেকারত্বের চাপে দেশের আইন শৃঙ্খলা ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দুটোই হুমকির মুখে পড়বে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজ সংস্কারক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া
পরবর্তী নিবন্ধআনন্দলোকে মঙ্গলালোকে