আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে নজর রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাজেটে নতুন নতুন উদ্যোগ যুক্ত করা হচ্ছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। এতে আরো জানা যায় যে, দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে প্রধান উপদেষ্টা দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি চান আগামী বাজেটে এ সংক্রান্ত প্রতিফলন যেন থাকে। সে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। আর বরাবরের মতো আগামী বাজেটেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। যাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মানোন্নয়ন হয়।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, বিনিয়োগ বাড়াতে যেভাবেই হোক জ্বালানি নিশ্চিত করবে সরকার। সার ও জ্বালানি বিষয়ে কোনো আপস করবে না সরকার। প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে না। তবে সিস্টেম লস কমিয়ে ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাজেটে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন–কানুন সহজীকরণের ঘোষণা দেবেন অর্থ উপদেষ্টা।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি বেগবান করতে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার, পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সার্বিকভাবে আর্থসামাজিকভাবে বৈষম্য কমানোর যে প্রয়াস থেকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল, তা পূরণের উদ্যোগ থাকবে বাজেটে। সরকারের আয় বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব বাজেট দেবে। আগের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান সুবিধা পাবে এমনটি হবে না। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। এর আগে মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠান বাড়তি সুবিধা পাওয়ায় অনেক ভালো উদ্যোক্তা পিছিয়ে পড়েছেন। এবার তা হবে না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা ও বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থা করা হবে।
আসলে কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিনিয়োগ। যত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি উৎপাদন এবং সেই অনুপাতে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। বাংলাদেশে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশি–বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিসংখ্যান বলছে, কর্মসংস্থান তৈরিতে দেশীয় বিনিয়োগের অবদানই তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদিও এ অভিযোগ বেশ পুরোনো যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হয়। বিডার বিনিয়োগসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে। বিডার বিনিয়োগবিষয়ক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৯–১০ সালে ৩৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৪১৮ জনের; সেই বছর ৮৯ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৫ জনের। ২০২০–২১ সালে ৬৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার দেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ১০০ মানুষের। অন্যদিকে ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ হাজার ৬৮৬ জনের। মোট ১২ বছরে, অর্থাৎ ২০০৯–১০ থেকে ২০২০–২১ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার স্থানীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে মোট ২৮ লাখ ১৭ হাজার ৯০২ জনের। একই সময় ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭৫ জনের।
বিশ্লেষকেরা বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা হয়, তা সাধারণত দেশেই থাকে এবং পুনর্বিনিয়োগ হয়। ফলে দেশের সম্পদ দেশেই বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় সংযোগ ও সহযোগী শিল্প গড়ে ওঠার অবকাশ তৈরি হয়। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফার একটি বড় অংশ নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যায়। স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে তাদের সংযোগে গভীরতা আসে না। ফলে স্থানীয় অর্থনীতি বিদেশি বিনিয়োগ থেকে যতটা উপকৃত হতে পারত, এসব কারণে ততটা পারে না। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়, স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, বিদেশি বিনিয়োগ থেকে ততটা হয় না।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে স্বস্তি না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবেন না। বিনিয়োগের যথোপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অধিকাংশ খাতে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি গঠনের সুযোগ থাকলেও কখনোই এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশ ভালো করেনি। এমনকি দেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফার হার ভালো হলেও দেশে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। তাই সবার আগে দেশে বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।