“আমি যে এখানে ১৭ মাস জেল খেটেছি, আমার অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ছোড ছোড ছেলেমেয়েরা এখন পথের মইধ্যে। আমার বাড়িঘর সবকিছু বেচাকেনা হয়ে গেছে।”
বিনাদোষে কারাগারে থাকা হাসিনা বেগম আজ মঙ্গলবার (৪ মে) দুপুরে আদালতের নির্দেশের পর বিকালে মুক্তি পেয়ে এমন প্রশ্ন করেন।
তিনি জানতে চান কোন দোষে তিনি এতদিন জেল খাটলেন আর ঘরবাড়ি হারিয়ে কীভাবে চলবে তার আগামী দিন। বিডিনিউজ
নিজের নামের একাংশ এবং স্বামীর নামের মিল থাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের এক মামলায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়া টেকনাফের হাসিনা বেগমকে আজ মঙ্গলবার দুপুরে মুক্তির নির্দেশ দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত।
মুক্তির পর বিকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের কান্নারত হাসিনা বেগম বলেন, “ওদেরকে (পুলিশ) বলেছিলাম, এটা আমার মামলা না। উনারা বলেছে, এটা কক্সবাজারের মামলা না বোন। চট্টগ্রামের মামলা, আমাদের কিছু করার নেই। ওইখানে (কক্সবাজার) ১০ দিন রেখেছিল আমাকে। যখন এইখানে চালান করে দেয় এখানকার অফিসেও (চট্টগ্রাম কারাগারে) বলেছিলাম।”
মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে হাসিনা বেগম বলেন, “আমার অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের কী হবে? আমি ১৭ মাস কেন জেল খেটেছি? বিনা দোষে কেন আমি জেলখানায় ছিলাম? এই দিনগুলো সরকার কখনো আমাকে ফেরত দিতে পারবে না।”
হাসিনা বেগমের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, “আগে অনেক উকিল ধরেছিল…। এই মামলায় পড়ে উনার বাড়িঘরও বিক্রি করে ফেলেছে, আমি যতটুকু জানি। নিজের টাকায় পিটিশন জমা দিয়েছি। আদালতে জানানোর পর তদন্তের নির্দেশ দেয়, উনি প্রকৃত আসামি কি না। কিন্তু পুলিশ অনেকদিন থেকে রিপোর্ট দিচ্ছিল না। প্রায় ছয়-সাত মাস পর্যন্ত দেয়নি। এরপর আমরা একটা প্রেয়ার দিলাম, একটা স্পেসিফিক ডেট দেয়া হোক। তারপর রিপোর্ট আসলো। তাতে উল্লেখ আছে এই মহিলার বয়স ৪০-৪২ বছর। আর যিনি আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেই মহিলার বয়স ২৭ বছর।”
আইনজীবী মুরাদ আরো বলেন, “তাহলে এই দু’জন কীভাবে এক হয়? দু’জনের বাড়িও ভিন্ন। পুলিশের গাফিলতির কারণে উনি দীর্ঘ দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। এই আদালতে এবং প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যে পুলিশ সদস্যরা এজন্য দায়ী তাদের ব্যাপারে কোর্টকে জানাবোযেন আইনি প্রতিকার পান।”
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শরীফুল আলম ভুঁঞার আদালত হাসিনা বেগমের মুক্তির আদেশ দেয়।
তার আগে টেকনাফ থানার পুলিশের প্রতিবেদন এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের রেজিস্টার যাচাই করে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয় সাজা ভোগকারী নারী প্রকৃত আসামি নন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে কারাগারে থাকা হাসিনা বেগম (৪০) কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইসমাইল হাজি বাড়ির হামিদ হোসেনের স্ত্রী। হাসিনা বেগম টেকনাফ পৌর সদরে একটি পান দোকান চালাতেন।
পুলিশ ও কারাগারের প্রতিবেদন যাচাই শেষে বিচারক অন্যের সাজা ভোগকারী হাসিনা বেগমকে মুক্তির নির্দেশ দেন। পাশাপাশি আদেশে পুলিশকে প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যে মামলায় হাসিনা বেগম কারাগারে ছিলেন সেই মামলার প্রকৃত আসামি টেকনাফ পৌর সদরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী বাড়ির হাসিনা আক্তার (২৭), তার স্বামীর নামও হামিদ হোসেন।
নগরীর কর্ণফুলী থানার মইজ্জ্যার টেক এলাকায় দুই হাজার ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন হাসিনা আক্তার ও তার স্বামী হামিদ হোসেন।
পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক হন। ওই ঘটনায় পুলিশের করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তাদের অনুপস্থিতিতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ দুই আসামিকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়।
সেই সাজা পরোয়ানা টেকনাফ থানায় পৌঁছালে ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৌর সদরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইসমাইল হাজি বাড়ির হাসিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
হাসিনা বেগম গ্রেপ্তারের পর তার দিনমজুর স্বামী হামিদ হোসেন এলাকা ছাড়েন। এই দম্পতির দুই মেয়ে এখন আছে হাসিনা বেগমের মায়ের কাছে। আর বড় ছেলে শামীম নেওয়াজ চট্টগ্রাম নগরীতে একটি বাসায় পরিচারকের কাজ করছেন।
শামীম নেওয়াজের কাছ থেকে তার মায়ের বিনাদোষে সাজা ভোগের বিষয়টি জানতে পেরে আইনজীবী মুরাদ আদালতে হাসিনার মুক্তির বিষয়ে আইনী লড়াই শুরু করেন।