চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডটি চট্টগ্রামসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ক্যান্সারের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল। ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পর থেকে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে রেডিওথেরাপি সেবা (মেশিন) রয়েছে কেবল এই হাসপাতালেই।
গোটা অঞ্চলে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে দ্বিতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানেই এ মেশিন নেই। মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এক মাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনও রয়েছে হাসপাতালের এ বিভাগে (যদিও বেশ কয়মাস ধরে মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে)। বেড়েছে ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যাও। আগে ২৪টি শয্যা থাকলেও বছর
দুই আগে তা বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়। সম্প্রতি শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৪টি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বেশ ক’বছর ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা সুবিধা বেড়েছে এখানে। তবে ওয়ার্ডে সেবা নিতে আসা গরিব–অসহায় রোগীরা অনেক দিন ধরে কষ্টে আছেন। প্রায় দুবছর ধরে সরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যের ওষুধ মিলছে না
ক্যান্সার ওয়ার্ডে। স্টক শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে না পাওয়ায় গরিব ক্যান্সার রোগীদের বিনামূল্যের এসব ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে ওয়ার্ড সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা যায়, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধগুলো খুবই ব্যয়বহুল। গরিবের নাগালের বাইরে বলা চলে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বেশি দামি ওষুধ দেয়া সম্ভব না হলেও বেশ কয়টি (প্রায় দশ) আইটেম ওষুধ (ইনজেকশান) গরিব রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ওয়ার্ড থেকে সরবরাহ
করা ইনজেকশানের মধ্যে– ডক্সোরোবিসিন, ইটোপোসাইড, সিসপ্লাটিন, ফাইভ এফ ও, ভিনক্রিস্টিন, ডাকার ভাজিন, মিথোট্রেক্সেট এবং ডসিট্যাক্সিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব ইনজেকশানের স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুবছর ধরে ওয়ার্ডের রোগীদের সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ওয়ার্ডের একাধিক চিকিৎসক জানান, স্টক না থাকায় রোগীদের বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যয়বহুল অন্য ওষুধের পাশাপাশি গরীব রোগীদের এসব ওষুধও বাইরের দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে।
ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতাল থেকে দেয়া এসব ওষুধ মাঝারি দামের বলা চলে। কিন্তু ক্যান্সার রোগীদের কমন ইনজেকশানগুলোর (যা বেশি দিতে হয়) দাম আরো বেশি। এর মধ্যে প্যাকলিটাক্সিল এর খরচ ৯ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা, ডসিট্যাক্সিলের খরচ ৮ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা, জেমসিটামিনের খরচ ৮ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা ও কার্বোপ্লাটিনের খরচ সাড়ে তিন হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার কম নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওষুধ ক্রয় বাবদ কেবল ক্যান্সার ওয়ার্ডের (৬নং ওয়ার্ড) জন্যই বছরে প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে একাধিক দফায় ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে এসব ওষুধ কেনা হয়ে থাকে। তবে ২০২১ সালের জুনের পর এ বিভাগের জন্য আর নতুন ওষুধ কেনা সম্ভব হয়নি। মূলত ক্রয়
প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জটিলতার কারণেই এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে– টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে এসব ওষুধ ক্রয়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দু’বছর ধরে টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানটি ওষুধ সরবরাহে দায়িত্ব পাচ্ছে, ক্যান্সার
ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা সে প্রতিষ্ঠানের ওষুধ অ্যালাউ করতে রাজি নন। গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওই প্রতিষ্ঠানের ওষুধ তারা রোগীদের প্রেসক্রাইব বা সরবরাহ করতে নারাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের
নীতিমালার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হাসপাতালের নেই। সবমিলিয়ে ক্রয় জটিলতায় বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহও বন্ধ রয়েছে ক্যান্সারের রোগীদের। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গরীব ও অসহায় ক্যান্সার রোগীরা।
রোগীদের কষ্টের কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, টেন্ডারে সরবরাহের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির ওষুধের মান নিয়ে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আপত্তি রয়েছে। তারা রোগীদের ভালো মানের ওষুধ দিতে চান। এজন্য ভালো মানের ওষুধ
ক্রয় করে সরবরাহ দিতে আমাদের বলছেন। কিন্তু আমরা তো চাইলেই নিজেদের মতো কিনে ফেলতে পারি না। মন্ত্রণালয়ের বেধে দেয়া নিয়মের মধ্যেই আমাদের ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। টেন্ডারে ভালো মানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হচ্ছে না। নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগও আমাদের নেই। সবমিলিয়ে একটি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকদের সাথে বিস্তারিত কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফ ছাড়াও ওই সময় সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল আউয়াল, সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী, রাকিবুল ইসলাম, রেজিস্ট্রার ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ শুভ, ডা.
ফাহমিদা ইসলামসহ আরো বেশ কয়জন চিকিৎসক সাথে ছিলেন। ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকদের দাবি– ক্যান্সারের চিকিৎসাটা এমনিতেই সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর)। এর মাঝে রোগীদের নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে আমরা ঝুঁকি নিতে চাই না। আমরা বলেছি, রোগীদের দিতে হলে ভালো মানের ওষুধ দেয়া উচিত।
যেনতেন ওষুধ দিয়ে আমরা রোগীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। টেন্ডারের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানের ওষুধ সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে, ওই প্রতিষ্ঠানের ওষুধের ব্যবহার এখন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ভালোমানের কোনও হাসপাতালে বা কোনও চিকিৎসক এসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না। আমরাও চাই ক্যান্সারের রোগীরা ওষুধ পেলে ভালো মানের ওষুধই পাক। ওষুধটা যাতে কাজ করে।
সর্বশেষ এ জটিলতা নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছেন জানিয়ে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে এবং এই সংকট সমাধানে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী
ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক।
ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধ–পত্রের দাম খুব বেশি উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা খুব বেশিদিন চালানো কঠিন। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় অধিকাংশ গরীব ক্যান্সার রোগীকেই মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়। ব্যয়বহুল এ রোগের
চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মন্তব্য করে ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা প্রয়োজন।