বিদ্যুতের অস্বাভাবিক লোডশেডিং আমাদের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গত ১ জুন দৈনিক আজাদীতে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটি হলো : চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ‘শোচনীয় পর্যায়ে’। এতে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেল সংকটে চট্টগ্রামের প্রায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন এই মুহূর্তে শোচনীয় পর্যায়ে। প্রাইভেট অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে আসছে। চট্টগ্রামের ২৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে এই মুহূর্তে উৎপাদনের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে মাতারবাড়ি ও বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি। মাতারবাড়ি ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে এখন প্রতিদিন গড়ে ৫৬৪ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অপরদিকে বাঁশখালী এস এস পাওয়ারের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক প্রকৌশলী জানান, জ্বালানি তেল সংকটে চট্টগ্রামের বেশিভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (সরকারি–প্রাইভেট) উৎপাদন ঠিক রাখতে পারছে না। দিনদিন জ্বালানি তেল সংকট প্রকট হয়ে উঠছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক কুমার চৌধুরী বলেন, আমরা এখন মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঁশখালী থেকে ১২শ’ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তেল ও গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কমেছে। আমাদের পিডিবির পাশাপাশি প্রাইভেট বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তেল ও গ্যাস নির্ভর। প্রাইভেট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন একটু কম হচ্ছে। আমাদের পিডিবির শিকলবাহা, দোহাজারী এবং হাটহাজারী কেন্দ্রগুলো চালু আছে। রাউজান গ্যাসের কারণে বন্ধ আছে, এটি দুই–একদিনের মধ্যে চালু হবে।
বিতরণ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, গরম কম থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা কম ছিল। গরম বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। বিশেষ করে এ সময়ে চাহিদা বেড়ে যায়। পাশাপাশি সেচের জন্যও ব্যয় হয় বাড়তি বিদ্যুৎ। কেননা রাতেই জমিতে সেচ দেওয়া হয়। ফলে গরম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়লেও লোডশেডিং করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা জানি, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি এমন পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে পারবে আমাদের বাংলাদেশ। তাঁরা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বাধা জ্বালানি সংকট। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে সময়মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁরা বিদ্যুতের অপচয় রোধেও গুরুত্বারোপ করেন এবং বলেন, ‘স্বাধীন দেশের সবাই সবকিছু স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেন। তবে দেশটা যেহেতু নিজেদের, সে ক্ষেত্রে দেশের সম্পদের ব্যবহার সঠিকভাবেই করা উচিত। বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়বে। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে এর অপচয় রোধ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের মন–মানসিকতার পরিবর্তন। বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো রকম রাজনীতি করা উচিত নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের অর্থনীতি একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।’ বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুতের অপচয় রোধের কিছু উপায় জানান। যেমন : প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাতি ও পাখা ছেড়ে রাখা উচিত নয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করুন, তা ছাড়া আছে কি না। এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে। বিনা প্রয়োজনে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ব্যবহার করা উচিত নয়। শিল্প–কারখানাগুলো রাতের বেলা চালু রাখলে বিদ্যুৎ কম খরচ হয়। শপিং মলগুলোয় আলোকসজ্জার ব্যবহার কমাতে হবে। কারণ, এসব আলোকসজ্জায় অনেক বিদ্যুৎ অপচয় হয়। বৈদ্যুতিক বিল সঠিক সময়ে দিতে হবে। এ ছাড়া রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো অনেক সময় দিনের বেলাও জ্বলে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা বাসায় থাকেন তাদের বেশি সচেতন হওয়া উচিত।
দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে তাতে বিকল্প উপায় বের করা জরুরি। তবে সাধারণ মানুষকেও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতন ও মিতব্যয়ী হওয়া দরকার। বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ হলেই তা সবার জন্যই সুফল বয়ে আনবে।
যেভাবেই হোক উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে এবং তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেবল তেল, গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভর করলে চলবে না; জলবিদ্যুৎ, বায়ুকল, সৌরবিদ্যুৎ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে।