সুশাসন নিশ্চিতকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ ও দক্ষ কর্মী পাঠানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। এতে বর্তমানের প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স মাত্র দুয়েক বছরের মধ্যে ৩০–৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে নেয়া সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সর্বোচ্চ এই খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ এবং অবৈধভাবে অন্তত এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করেন। তাদের মধ্যে অদক্ষ মানুষের সংখ্যাই বেশি। যারা অত্যন্ত স্বল্প বেতনে ওখানে কাজ করেন। কিন্তু অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে কিছু ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে পাঠানো সম্ভব হলে তাদের বেতন ভাতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতো। ভারত এবং ফিলিপাইনের একজন দক্ষ শ্রমিক যে পরিমাণ বেতন ভাতা পান, বাংলাদেশের অদক্ষ একজন শ্রমিক তার অর্ধেকও পান না। ফলে দেশের আয় কমছে। অথচ একজন দক্ষ শ্রমিক বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারলে ওই একই খরচেই বাড়তি আয় করতে পারে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। দেশটি ২০৩০ সালকে সামনে রেখে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রম রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশ যখন দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বাজার দখল করছে তখন আমাদের অদক্ষ শ্রমিকেরা স্বল্প বেতনে ওই সব উন্নয়ন প্রকল্পের ইট পাথর টানছেন। ২০২৪ সালে দেশের মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। গত বছর দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬.৮৮ বিলিয়ন ডলার। এটি এযাবতকালের রেমিটেন্সের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলেও সূত্র জানিয়েছে। ২০২৪ সালে সৌদি আরব ৬ লাখ ২৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়েছে। যা মোট জনশক্তি রপ্তানির অন্তত ৬২ শতাংশ। এটিও একটি রেকর্ড। এর আগে এক বছরে কোনদেশেই এতো বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়নি।
তবে এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধুমাত্র একটি দেশের উপর এই নির্ভরশীলতা আমাদেরকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। বিকল্প বাজার তৈরি না রাখলে যে কোন সময় পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেই দেশের অর্থনীতিতে তার বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে। তারা বলেন, ২০২৪ সালে বিদেশে পাঠানোর কর্মীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই গিয়েছেন মাত্র ছয়টি দেশে। দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান। এই দেশগুলোর কোনটির সাথে সম্পর্কের এদিক–ওদিক হলেই তার প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারে। যেমনটি পড়েছে ওমান, বাহরাইন, কুয়েতসহ এক সময়কার বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজারগুলোর ক্ষেত্রে। এসব দেশে একসময় প্রচুর কর্মী পাঠানো সম্ভব হলেও গত কয়েকবছর ধরে বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়াও চার বছর কর্মী নেয়া বন্ধ রেখেছিল। তবে গতবছরের মাঝামাঝিতে এসে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের শ্রমবাজার একেবারে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে। গত পাঁচ বছর দেশ থেকে পাঠানো ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল মাত্র দশটি দেশে। এসব দেশ কখন যে কোন স্বার্থে কোথায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এ জন্য বাজার সম্প্রসারণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের দূতাবাস রয়েছে। ওসব দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিকরা যদি যথাযথভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৃষ্টি করতেন তাহলে আরো অনেক বেশি দেশে আমাদের বিপুল পরিমান কর্মী পাঠানো সম্ভব হতো। তবে অদক্ষ কর্মীর চেয়ে দক্ষ কর্মী পাঠানোর জন্য দেশে সরকারকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
বিদেশে বাংলাদেশের কর্মীদের সুনামের পাশাপাশি নানাভাবে দুর্নামও রয়েছে। প্রতিযোগি দেশগুলোর মিথ্যা প্রচারণা, শত শত রোহিঙ্গা যুবকের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়া, জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলোর প্রতারণাসহ নানা কারনে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটে রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিদেশি দূতাবাসগুলো শ্রমবাজারের জন্য বড় ধরণের একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন। যা হাতে গোনা কয়েকটি দেশের উপর থেকে বাংলাদেশের নির্ভরতা কমাবে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, শুধু বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারটাকে ঠিকঠাকভাবে স্বস্তিতে রাখা গেলে রেমিটেন্স প্রবাহ প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা কঠিন হবে না। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করতে পারলে মাত্র দুই তিন বছরের মধ্যে এই টার্গেট অর্জন করা সম্ভব।
প্রবাসী কল্যাণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের একজন কর্মকর্তা বিদেশে অদক্ষ শ্রমিকই বেশি বলে স্বীকার করে বলেন, একটি বিষয় দাঁড়িয়ে গেছে যে, দেশে যে ছেলে কোন কাজ করতে পারছে না, সেই বিদেশ যাবে। কিন্তু ব্যাপারটি এমন হওয়া উচিত ছিল না। বরং কাজ জানা লোককে বিদেশে পাঠানো হলেই দেশের রেমিটেন্স বাড়বে। পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটগুলো থেকে শর্ট টাইম কোর্স, ড্রাইভিং, পাইপ ফিটিংসের কাজসহ বহু কাজেরই দক্ষ কর্মীর বহু দেশেই অভাব রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।