বাংলাদেশ সম্পর্কে রচনা লিখতে গিয়ে অধিকাংশ ছাত্র–ছাত্রী যে বাক্যটা দিয়ে রচনা আরম্ভ করতো তা হলো– সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা– আমাদের এ বাংলাদেশ। এর একটা কারণ আছে। বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটি দেশ, যে দেশে বৎসরের ১২ মাসই ফল–ফলাদি পাওয়া যায়। ছোট বেলায় ‘বাল্যশিক্ষা’– নামক একটি পুস্তিকা হাতেকড়ি দেয়ার পর থেকে প্রত্যেককে পড়ানো হতো। এ বইটিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলের নাম ছড়া আকারে দেয়া আছে। সেই ছড়াটি এখনো মনের মনিকোটায় স্পষ্ট ভাসমান। শিশু অবস্থায় মা রান্না করতে করতে ছালা বিছিয়ে তার ওপর বসে মায়ের সম্মুখে এ পুস্তিকাটি অন্তত চার বার শেষ করেছি। ফলে আজ জীবনের অপরাহ্নেও সেই ছড়াগুলো মনের মধ্যে স্পষ্ট ভাসে। এই যে বাংলাদেশের ফলের নামগুলো হচ্ছে– আম, জাম, নারিকেল, সুপারি, কাঁঠাল, দাড়িম্বু, কমলা, কলা, কামরাঙা, তাল। বেল, লেবু, আনারস, আতা, হরিতকি, তরমুজ, ফুটি, লিচু, আমলকি। এখানে বাংলাদেশের উনিশটি ফলের নাম বর্ণিত আছে। বাংলাদেশের এই ফলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ফল সারা বৎসর পাওয়া যায়। যেমন– নারিকেল, কলা, লেবু ইত্যাদি। অবশিষ্ট ১৬টি ফল ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে এক এক ঋতুতে পাওয়া যায়। যেমন– গ্রীষ্মের ভরা মৌসুমে পাওয়া যায় আম। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং বর্ষার আগমনের প্রারম্ভে পাওয়া যায় জাম ও কাঁঠাল। কামরাঙা, তাল, আনারস পাওয়া যায় বর্ষা মৌসুমের শেষে দিকে। এভাবে প্রকৃতির সাথে মিশে আছে এদেশের মানুষের জীবন। কিছু কিছু ফল এদেশে উৎপাদন হয় না। যেমন– আপেল, আঙুর, মিষ্টি কমলা, মোছাম্বি, আনার ইত্যাদি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এ ফলগুলো কালেভাদ্রে বাজারে পাওয়া গেলেও এই ফলগুলোর দাম ছিল সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে মানুষের জীবনের শেষ প্রান্তে কোনো কোনো বৃদ্ধ মানবের প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠতো একটু আঙুর খাওয়ার জন্য। তখন এ জীবনে আঙুর ফল খাওয়ার স্বাদ মিটানোর জন্য অধিক দামে আঙুর ক্রয় করে এ স্বাদ মিটানো হতো। এমনও দেখা গেছে, মৃত্যুর পথযাত্রী কোনো ব্যক্তিকে আঙুর কিনে এনে শয্যা অবস্থায় তার মুখে আঙুরের রস দিতে। এটা কোন গল্প নয়। এটাই ছিল গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্র। এ চিত্র স্বাধীনতা পরবর্তী নব্বই এর দশক পর্যন্ত ছিল।
এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ হয়েছে স্বাস্থ্য সচেতন। তাই বেড়েছে আঙুর, মিষ্টি কমলা, আপেল, আনার ও অন্যান্য মিষ্টি ফলের চাহিদা, যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যে কোনো পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলারের (আমেরিকান ডলার) প্রয়োজন হয়। পণ্য রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত ডলার জনশক্তি রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে জমা হয়। সেই রিজার্ভের ডলার থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি, ঋণের অর্থ পরিশোধ, কর্তা ব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণ, বিপুল সংখ্যক ছাত্র–ছাত্রীদের বিদেশে পড়ালেখা, বিদেশে চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে। পণ্য আবার অনেক ধরণের। যেমন– অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি, কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি এবং বিলাস বহুল পণ্য আমদানি। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য বলতে খাদ্য, জ্বালানী, জটিল রোগের ঔষধ ইত্যাদি। যদি খাদ্য আমদানি কম হয় তবে এদেশের অসংখ্য লোক অভুক্ত থাকবে। খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। এমন কি দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। জ্বালানীর যদি ঘাটতি থাকে তবে সমগ্র দেশে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সমগ্র দেশে অরাজকতা দেখা দেবে। অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। খাদ্য উৎপাদনে যেহেতু সেচের ব্যবহার প্রয়োজন হয়, সেহেতু জ্বালানীর ঘাটতি দেখা দিলে অথবা দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর ফলে পণ্যের দামও বাড়বে। আবার অতি জটিল রোগের ঔষধগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় না। এসব জীবন রক্ষাকারী ঔষধগুলোকে আমদানি করতে হয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। আবার কতগুলো কম প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্য রয়েছে। যেমন– বিদেশি পোশাক, কাপড়, সেন্ট, সেম্পু, বিভিন্ন প্রকারের ফল ফলাদি ইত্যাদি। এই পণ্যগুলো আমদানি না করলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। যদি বলা যায়, ঈদ, পূজা পার্বণে সুন্দর সুন্দর পোশাক সন্তানদের আনন্দ দেয়। কিন্তু তার বিপরীত কথা হলো দেশে তৈরি পোশাক কোনো অংশে খারাপ নয়। বিদেশি পোশাক, ফল–ফলাদি আমদানি করার কোনো যুক্তি নেই। পোশাক দরকার হয় বৎসরে দুই একবার। কিন্তু বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সারা বৎসর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফল ফলাদি বিক্রি করা হয়। শুধু তাই নয়। রাজধানীর সকল অংশ থেকে শুরু করে এদেশের গণ্ড গ্রামের আনাচে কানাচে পর্যন্ত আমদানিকৃত ফলে সয়লাব। এই ফল সামগ্রি আমদানি করতে ব্যয়িত হয়েছে লক্ষ লক্ষ ডলার। আবার এ ডলার ব্যয়িত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে। ২০২৩–২৪ অর্থ বছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন বা প্রায় ৬০ কোটি কেজি। আর ২০২২–২৩ অর্থ বছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৭৯ হাজার টন। অর্থাৎ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ফল আমদানি কমেছে ১০ হাজার টন। এই পরিমাণ ফল কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ন্যূনতম ১৬ হাজার কোটি টাকা। আমদানি করা ফলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশ থেকে ৩৮ ধরণের ফল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানির ৯৫ শতাংশই আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। বাকি ৫ শতাংশ ফলের মধ্যে রয়েছে নাসপাতি, কিনুই, কতবেল ইত্যাদি।
ফলের দাম যে কম তা কিন্তু নয়, বিদেশি ফলের দাম বাড়তে শুরু করে মূলত ২০২২ সালের জুন–জুলাই থেকে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিদেশি ফলের শুল্ক কর বৃদ্ধি ও ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে যায়। এর বিপরীতে কমে চাহিদা। ২০২২ সালের মে মাসে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ)। এতে ফল আমদানিতে শুল্ক কর বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার ফল আমদানিতে সরকারকে রাজস্ব দিতে হবে ১১৩ টাকা ৮০ পয়সা। আবার ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শুল্ক কর ও আমদানি মূল্যও বেড়েছে। যেমন– প্রতি কেজি আপেল আমদানিতে ২০২১–২২ অর্থবছরে শুল্ক কর ছিল প্রায় ৩৯ টাকা। ২০২২–২৩ অর্থবছরের শুরুতে প্রতি কেজি আপেল আমদানিতে শুল্ক কর দাঁড়ায় ৮৮ টাকা।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে চীন থেকে ফল আমদানি হয়েছে ২ লাখ টন যা মোট আমদানি ৩৪ শতাংশ। চীন থেকে আপেল, কমলা, আঙুর, নাসপাতি এ চারটি ফল বেশি আমদানি হয়েছে। আর ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার টন যা মোট আমদানির ৩৩ শতাংশ। ভারত থেকে মূলত: মাল্টা, আঙুর ও আনার বেশি আমদানি হয়েছে। ফল আমদানির তৃতীয় উৎস দেশ হয় আফ্রিকা। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশটি থেকে ফল আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ৬৬২ টন। তাছাড়া মিশর, থাইল্যাণ্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে নানা ধরণের বৈচিত্রময় ফল। এনবিআর এর হিসেব অনুসারে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১১৭ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ হয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। জাহাজভাড়া, বিমাসহ সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। ফল আমদানিতে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, ফল আমদানিতে মোট খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। আর সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ফল আমদানি খরচের তুলনায় অধিক। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ঠিকই, তবে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে। ফল আমদানি যদি না করতো তবে সরকারের রিজার্ভে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বা ৩০০ বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকতো। এই পরিমাণ ডলার দিয়ে সরকার খাদ্য ও জ্বালানীর মত অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারতো। অবশ্য এক্ষেত্রে সরকার কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে। তবুও সরকারকে অবশ্যই ফল আমদানির পরিমাণ হ্রাস করা উচিত। তখন বিদেশি ফলের পরিবর্তে জনগণ দেশি ফল ক্রয় করতে বাধ্য হবে। তাছাড়া সরকারকে বিলাসবহুল পণ্যগুলোর আমদানিও হ্রাস করতে হবে।
লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম।