বিদায়! লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল

পাভেল রহমান | বুধবার , ১৮ মে, ২০২২ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আজ সব কিছু ছাপিয়ে অ্যামেরিকান এক জেনারেলের কথা মনে পড়েছে। ইরাকের আগ্রাসনের পর কুয়েত উদ্ধারের শেষে দেশে ফেরার পথে সেই জেনারেল তাঁর বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রামের উপকূলে, সাইক্লোন বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাঁর সাথে আমার পরিচয় সেইসময় দুর্গত অঞ্চলে। কিন্ত দুর্ভাগ্য, যার কথা বলতে বসেছি তিনি আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই।

অ্যামেরিকান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল ইরাকের হাত থেকে কুয়েত উদ্ধারের পর সৌদি আরবে অবস্থান করা অ্যামেরিকান মেরিন সেনাদের নিয়ে দেশে ফিরছিলেন। যুদ্ধ বিজয়ের পর ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানডিয়েগো নৌ ঘাঁটিতে ফেরার নির্দেশ পেয়ে তিনি রণতরী ‘ইউ এস এস তারাওয়া’ নিয়ে যখন আরব সাগর পাড়ি দেবেন, তখনই ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদরদপ্তর থেকে খবর এলো, ‘ডেসটিনেশন ভারত সাগর। যুদ্ধ নয়, মানবিক ডাকে সাড়া দিয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে হবে।

যুদ্ধবাজ অ্যামেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্‌রুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ কল নেমের দলটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সহযোগিতা করতে নতুন নাম ‘অপারেশন প্রডাক্টিভ এফোরড’ ধারণ করে। সমর সাজে সজ্জিত রণতরী ‘ইউ এস এস তারাওয়া’ দিক পরিবর্তন করে আরব সাগর থেকে স্যানডিয়েগো না গিয়ে চলে আসে ভারত মহাসাগরে, বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইক্লোনের আঘাতে বিপর্যস্ত লক্ষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

পেন্টাগনের তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এহেন সিদ্ধান্তে প্রথম দিকে ধাক্কা লাগে আমার মনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই ভারত মহাসাগরের পথেই পাকিস্তানের সমর্থনে ছুটে এসেছিল অ্যামেরিকান অন্যতম ভয়ংকর যুদ্ধ জাহাজে সাজানো সপ্তম নৌবহর। আমরা অবরুদ্ধ বিজয় পাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তখন রুদ্ধশ্বাসে প্রহর গুনছি। এদিকে আমাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে ছুটে এসেছিল সোভিয়েত রণতরীর দল আর ভারতীয় নৌবাহিনী, ভারত মহাসাগরে অবরোধ গড়ে তুলতে। তখন অ্যামেরিকান সপ্তম নৌবহর অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হঠে যায়। আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্য তখন পূর্ব রণাঙ্গনে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে।

সেই অ্যামেরিকানরা এবার আসছে ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন নামে, আসছে রণতরী ইউ এস এস তারাওয়া! আর একথা তো সবাই জানে ঘরপোড়া গরু তো সিঁদূরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়! ভারত সাগরে নোঙ্গর করা রণতরীর মার্কিন সেনাদের হোভারক্র্যাফ্‌ট (পানিতে কিংবা ডাঙ্গায় ছুটে বেড়ানো উভচর যান) সাগর থেকে কর্ণফুলীর পানিতে ফোয়ারা ছিটিয়ে ছুটে এলো পতেঙ্গায়। উৎফুল্ল হাজারো পতেঙ্গাবাসি করতালিতে স্বাগত জানালো মেরিন সেনাদের। মেরিনদের আগমনের অপেক্ষায় পতেঙ্গার পাড়ে আমরা সাংবাদিকরা ছিলাম অধীর আগ্রহে।

আমাদের প্রয়াত এপি রিপোর্টার দিলীপ গাঙ্গুলী এবং চট্টগ্রামের সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুর অ্যামেরিকান মেরিনদের আগমনের উপর তৈরী করেছিলেন অবিস্মরণীয় এক রিপোর্ট। নিউ ইয়র্ক টাইমসএর প্রথম পাতায় ছাপা সেই রিপোর্টের হেডলাইন দিয়েছিল ‘এঞ্জেলস আর কামিং’! এপির রিপোর্টে মুগ্ধ পেন্টাগন জরুরি বার্তা পাঠায় জেনারেল স্ট্যাকপোলকে। তাঁরা দ্রুত অপারেশনের কল নেম পরিবর্তন করে ‘অপারেশন প্রডাক্টিভ এফোরড’ এর জায়গায় নুতন নামকরণ করলেন ‘অপারেশন সী এঞ্জেলস’! এপি রিপোর্টার দিলীপ গাঙ্গুলীর অবিস্মরণীয় সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই পেন্টাগনের নুতন নামকরণ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে যায় মুহুর্তের মধ্যে। দিলীপদা, ওসমান গনি মনসুর এর সাহায্যে শুদ্ধ বাংলায় ট্রান্সলেট করে দেন পতেঙ্গার মানুষদেরই কোট করে মেরিনদের হোভারক্র্যাফ্‌েট চড়ে ছুটে আসার চিটাগনিয়ান ভাষা আর স্থানীয় উচ্চারণ, উপস্থিত এক বর্ষীয়ান বর্ণনা দেন এভাবে – ‘ মনে হচ্ছিল সাগরের পানির ফোয়ারা তুলে ছুটে আসছেন ফেরেশতারা, আমাদের সাহায্য করতে’! সে থেকেই ‘অপারেশন সী এঞ্জেলস’ নামকরণ!

আজ সাংবাদিক দিলীপ গাঙ্গলী আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল, কেউই আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্ত ঐ ঘটনার কারণে লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্ট্যাকপোলের সাথে আমার আর দিলীপদার, দুজনেরই সুসম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। তিনি চট্টগ্রামে হোটেল আগ্রাবাদের স্যুইট রুমে আমাদের ক্যাম্প অফিস ভিজিট করতে এসে আমার ছবি পাঠানোর সিস্টেম দেখলেন, বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। একজন সদ্য যুদ্ধজয়ী জেনারেলের এমন অহংকারহীন বিনয় আমাকে মুগ্ধ করে।

সেই সময় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকলেও এপি সেট ফোনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের খবর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম। যদিও সেই সেট ফোনের কল রেট সে সময় ছিল প্রতি মিনিটে ৮ পাউন্ড!

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল ছিলেন দারুণ হাস্যরসে ভরা হৃদয়বান এক মানুষ। সচরাচর দেখা জেনারেলদের মত গুরুগম্ভীর ছিলেন না তিনি, তাঁর মুখে সবসময়ই লেগে থাকতো হাসি। আর শুধু সাংবাদিকদের সাথে নয়, তাঁর সহকর্মী অফিসারদের সাথেও তিনি ছিলেন অমায়িক, এমনকি একজন সাধারণ সৈনিকের সাথেও মিশতেন সহজ সরলতায়!

একদিন আমরা পতেঙ্গায় বিমানবন্দরে হেঁটে যাচ্ছি একটা ব্ল্যাক হক হেলিকপটারের দিকে। এমন সময় একজন মেরিন সেনা তাঁর উদ্দেশ্যে হাসতে হাসতে বলে বসলো, ‘হেই জেনারেল, দেখো দেখো তোমার জুতার ফিতা খোলা’!

সৈনিকেটি কি অবলীলায় একজন জেনারেলের সাথে এমন ভঙ্গিমায় কথা বললো, যেন জেনারেল তাঁর বন্ধু! জেনারেলও সৈনিকের দিকে হাসি ছুড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটু গেড়ে ফিতা বাঁধতে লাগলেন। এই দৃশ্য আমার কাছে অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য! সেই কণ্ঠ আমার মনের মণিকোঠায় সযত্নে রাখা আছে, এক জেনারেলকে কত সহজে জুতার খোলা ফিতা বাঁধার কথা বলে গেলেন সেই সৈনিক!

পরবর্তীতে আমার অ্যামেরিকা ভিজিটের খবরে উৎফুল্ল ছিলেন জেনারেল স্ট্যাকপোল। তিনি যখন জানলেন আমার বড় বোন লস এঞ্জেলেসএর প্যাসাডেনায় থাকেন, তখন বললেন ‘ওহ প্যাসাডেনা! ভারী সুন্দর এলাকায় থাকেন তোমার বোন। আমাদের নৌ সেনাদের ঘাঁটিও কাছেই স্যানডিয়েগোতে। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের ওখানে বেড়াতে আসবে, আর তোমার বোনকেও সাথে করে নিয়ে আসবে মাত্র তিন ঘণ্টার ড্রাইভ ’।

জেনারেল স্ট্যাকপোলের সাথে আমার শেষ দেখা ঢাকার প্রেস ক্লাবে। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে যাওয়ার বছর তিনেক পর একটা ফ্রেন্ডশিপ ট্রিপে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। সেই হাস্যরস তখনও ছিল তাঁর মুখে। স্মৃতি রোমন্থন করলেন ‘অপারেশন সী এঞ্জেলস’ নিয়ে, ছবিতে লিখে দিলেন শুভেচ্ছা!

পৃথিবীর অন্যতম সুপার পাওয়ার অ্যামেরিকা। সেই অ্যামেরিকার একজন যুদ্ধ বিজয়ী লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল এর অমায়িক ব্যবহারে আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম, যে আমার দেখা অন্য সব মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, ফিল্ড মার্শালদের সবার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

জীবন কি জীবনের মত?

থাকতে নেই ভেদাভেদ উঁচুতে আর নিচুতে।

আমাদের ধর্ম যে সে কথাই বলে!

লেখক: সাংবাদিক, নিউ ইয়র্ক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধআইএলও কনভেনশন ১৩৮ এবং শিশু শ্রম