সরকার পতনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন দাবি করে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, মুসলমানদের বাড়িতে বেশি আক্রমণ হয়েছে। এসব হামলা সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনৈতিক। গত কয়েকদিন ধরে মাজারে হামলা ও লুটপাটের ঘটনাগুলো গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, এগুলো যেভাবে আছে, সেভাবে থাকা উচিত। বাংলাদেশে জামায়াতের গুরু গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেছেন, বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজ সরকার করবে না। খবর বিডিনিউজের।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে গতকাল শনিবার দুপুরে রাজশাহী ইসলামিক ফাউন্ডেশন চত্বরে এক মতবিনিময় সভা করেন উপদেষ্টা। এতে উলামা মাশায়েখরা ছাড়াও অংশ নেন হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মের নেতারা। এই মতবিনিময়ে যোগ দেওয়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন উপদেষ্টা। সরকার পতনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নে উপদেষ্টা খালিদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে বিজয় এসেছে, এরপরে বিদেশি মিডিয়াতে বলা হচ্ছে– এখানে সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম– এসব ধর্মের মানুষের বাড়িঘর–উপাসনালয়ে হামলা হচ্ছে। হামলা যে একেবারে হয়নি সেটা বলব না, তবে সেটা বিক্ষিপ্ত। এটা খুব বেশি গুরুত্ব রাখে না। ঘরবাড়ি যদি আগুন দিয়ে থাকে, মুসলমানদের বাড়িতে তো আরও বেশি আগুন দেওয়া হয়েছে, মসজিদও তো আক্রান্ত হয়েছে। এই আক্রমণ কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে হয়নি মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, এটা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে।
প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে দুইবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়া, মতিঝিলে সেনাকল্যাণ সংস্থার পাশে শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিও মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের কথা জানিয়ে খালিদ হোসেন বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের যে কথা বলা হয়েছে, আমি মনে করি এর কোনো সত্যতা নেই। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ। বিক্ষিপ্ত ঘটনা হতে পারে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে।
দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের জমিতে কিছু লোকের মসজিদ নির্মাণের চেষ্টার খবর পাওয়ার পর সেটি ঠেকানোর কথাও জানান উপদেষ্টা। বলেছেন, ওখানে মসজিদের পাশে খাস জমি আছে, সেটি লিজ নিয়ে মসজিদ সম্প্রসারণ হোক, দেবত্তোর সম্পত্তি মন্দিরের থাকুক।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বাংলাদেশের ঐহিত্য তুলে ধরে খালিদ বলেন, এটা অটুট থাকবে। আমি কেবল মুসলমানদের উপদেষ্টা নয়, আমি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদেরও, বৌদ্ধদেরও, খ্রিষ্টানদেরও উপদেষ্টা। তাদেরও অধিকার আছে, মুসলমানদেরও অধিকার সমান। আমরা সব সময় তাদের পাশে আছি, পাশে থাকব।
গত কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন মাজারে হামলা ও লুটপাট বিষয়ে উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে তিনি বলেন, মাজার ভাঙা হোক, মসজিদ ভাঙা হোক, মন্দির ভাঙা হোক, এগুলো গর্হিত কাজ। এগুলো যেভাবে আছে, সেভাবে থাকা দরকার। আমরা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, এরকম যদি কোনো ঘটনা হয় যেখানে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হবে, আপনারা আমাদের জানালে মুহূর্তের মধ্যে সেটা আইনগত ব্যবস্থা নেব। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে যারা হামলা চালায়, তাদেরকে মানবতার শত্রু ও অপরাধী মন্তব্য করে উপদেষ্টা খালিদ বলেন, আমরা অপরাধীদেরকে ধরে আইনের আওতায় আনার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এবার দুর্গাপূজার নিরাপত্তায় মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্তের কথাও তুলে ধরেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমরা আশা করি সনাতনী ভাইয়েরা উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে দুর্গাপূজা পালন করতে পারবে। আমরা প্রতিটি জায়গায় পুলিশ নিয়োগ করব, স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে এবং পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ‘দেশে ৩২ হাজার পূজামণ্ডপ আছে, সব জায়গায় সিসিটিভি বসানো সম্ভব নয়। স্থানীয় মানুষদেরকে নিলে এবং মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে নিলে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থাকলে আমার মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। দুর্ঘটনা যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটায় এবং আমাদের নজরে আসে আমরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিষয়ে গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমীর দাবির প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, এগুলো বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাও বার বার বলেছেন, বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো জায়গায় আমরা হাত দেব না। আমরা হলাম অন্তবর্তীকালীন সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আমাদের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। আরও আসছে। এটাকে যদি আমরা আরও বেশি বাড়াতে পারি, একটা ভালো পরিবেশ যদি এ দেশে তৈরি হয়, যখনই তৈরি হবে– আমরা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজিয়ে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেব।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে বিষয়েও সরকারের ধর্ম উপদেষ্টার বক্তব্য জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি বলেন, আমরা বৃহত্তর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বহাল রাখতে চাই। রাজনাথ মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য আমরা শুনেছি। কিন্তু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি আছে। সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়, এটাই আমাদের নীতি হয়ে আসছে। আমাদের ক্রিকেট দল ভারতে গেলে হামলা করবে, এ রকম খবরও মিডিয়াতে আসছে। এটা নিয়ে আমাদের আলাদা ক্রিকেট বোর্ড আছে, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আছে– ওনারা এটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
হজের খরচ কি কমবে? এ বিষয়ে প্রশ্নে ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, হজের সময় হাজিরা যে টাকা দেন, তার একটি পয়সাও আমরা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে রাখি না। অনেকে মনে করে থাকেন এটা, কিন্তু আমরা এক কোটি টাকার ওষুধ দেই হাজীদের জন্য, ৮০ জন ডাক্তার, আরও ২০–৩০ জন নার্স সাথে রাখি, প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। সৌদি আরবের সাথে আমাদের চুক্তি আছে, যদি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, যদি হার্ট ফেইল করে অথবা জ্ঞান হানায়, আমরা তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করি। এই খরচ তো আমরা হাজিদের কাছ থেকে নেই না। এটা আপনি বলতে পারেন হাজীদের জন্য ভর্তুকি।
বিমান ভাড়া ও সৌদি আরবে থাকা–খাওয়াই হজের মূল খরচ জানিয়ে তিনি বলেন, সৌদি সরকারকে একটা বড় অঙ্ক দিতে হয়, অনেকে জানে না। মিনা, আরাফায় তাবুতে যে থাকবে, এগুলোর নিরাপত্তার জন্য সৌদি আরব একটা টাকা নেয়। সারা বিশ্ব থেকেই নেয়, আমরাও দেই। এ মাসেই সৌদি হজমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে জানিয়ে খালিদ হোসেন বলেন, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যে খাতে কমানো যায়, সে খাতে কমিয়ে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্যাকেজ ঘোষণা করতে চাই।