বিতর্ক শুধু বক্তৃতা নয় এটি এক বুদ্ধিদীপ্ত ভাব বিনিময়

সাইফ চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১২ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

বিতর্ক অনেকেই শুধু বক্তৃতা বলেই মনে করে। কিন্তু বাস্তবে বিতর্ক হলো এক ধরনের জ্ঞানের লড়াই, যেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তি, তথ্য ও বিশ্লেষণ। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বক্তা নিজের মতামত তুলে ধরে, কিন্তু সেই মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় শক্তিশালী যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে। বিতর্কে প্রতিপক্ষকে অপমান বা পরাজিত করা নয়, বরং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আলোচনার মাধ্যমে সত্য বা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই মূল লক্ষ্য।

একটি ভালো বিতর্ক ব্যক্তি ও সমাজকে নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা কেবল নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে না, বরং বিপরীত মতকেও বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে করে একজন বিতার্কিক চিন্তাশীল, সহনশীল ও যুক্তিবান নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। এখানে প্রতিপক্ষকে হারানো নয়, বরং সত্যকে আবিষ্কার করাই মূল লক্ষ্য।

সুতরাং বিতর্ক কেবল বক্তৃতা দক্ষতা নয়, এটি একটি মানসিক অনুশীলন যেখানে চিন্তা, যুক্তি ও জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। বিতর্ককে তাই দেখতে হবে একটি জ্ঞানের মঞ্চ হিসেবে যেখানে মতের ভিন্নতা থাকলেও লক্ষ্য একটাই: সত্য ও যৌক্তিকতার বিজয়।

বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানের অন্বেষণ: একজন বিতার্কিক যখন একটি বিষয়ের উপর বিতর্কের জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন তাকে শুধুমাত্র নিজের মত প্রকাশের জন্যই নয় বরং প্রতিপক্ষের যুক্তি বুঝে তার জবাব দেওয়ার প্রস্তুতিও নিতে হয়। এজন্য প্রয়োজন হয় বিষয়ভিত্তিক গভীর জ্ঞান। এই প্রক্রিয়ায় বিতার্কিককে পড়াশোনা করতে হয় ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এমনকি সামপ্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিও।

বিতর্ক শেখায় কীভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিষয় বিশ্লেষণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি নাকি শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ?’ এমন একটি বিষয়ের পক্ষেবিপক্ষে যুক্তি তৈরির জন্য একজন বিতার্কিককে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জাতীয় বাজেট, জনকল্যাণ, সামরিক নিরাপত্তা এবং উন্নয়ননীতির মত বিষয় সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয়। ফলে বিতর্ক হয়ে ওঠে এক অনন্য জ্ঞানের জগৎ।

বিতর্ক মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতা তৈরি করে। বিতর্কে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যুক্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি সহাবস্থান ও সহমর্মিতা শেখায়, যা একজন দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব বিকাশে বিতর্কের ভূমিকা: বিতর্ক একজন ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব গঠনে এর অবদান অনস্বীকার্য।

.যুক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, .আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, .যোগাযোগ দক্ষতা উন্নয়ন, .সহনশীলতা ও শ্রবণ দক্ষতা, .সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, .দলবদ্ধ কাজের অভ্যাস।

সুতরাং, বিতর্ক একজন ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী, যুক্তিবাদী, নেতৃত্বদানে সক্ষম ও কার্যকর যোগাযোগকারী করে তোলে, যা আধুনিক যুগে একজন সার্থক নেতার অপরিহার্য গুণাবলি।

বিতর্ক মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতা তৈরি করে। বিতর্কে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যুক্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি সহাবস্থান ও সহমর্মিতা শেখায়, যা একজন দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

শিক্ষা ব্যবস্থায় বিতর্কের ভূমিকা : একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিতর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। বিতর্ক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি গড়ে তোলে এবং মুখস্থ নির্ভর শিক্ষার বাইরে বেরিয়ে এসে নিজে থেকে চিন্তা করার অভ্যাস তৈরি করে। বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিতর্ক কর্মশালা আয়োজন করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের ভাষাশৈলী, তথ্যনির্ভরতা এবং আত্মবিশ্বাস গঠনে সহায়ক। এছাড়াও, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, মেশিন লার্নিংয়ের মতো জটিল বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক শিক্ষার্থীদের সেই প্রযুক্তিগত বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়। বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থী কেবল একটি বিষয়ের পৃষ্ঠস্থ তথ্য জানে না, বরং সেই তথ্যের প্রেক্ষাপট, বিশ্লেষণ এবং তার বাস্তব প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শেখে।

সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার: বিতর্কের একটি বড় সামাজিক ভূমিকা হলো সচেতনতা তৈরি। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যেমন নারী অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এ নিয়ে যখন তরুণরা বিতর্কে যুক্তি তুলে ধরে, তখন তা সমাজের অন্য সদস্যদের চিন্তা করতে বাধ্য করে। ফলে বিতর্ক হয়ে ওঠে সচেতন নাগরিক গঠনের এক কার্যকর হাতিয়ার।

সামাজিক আন্দোলন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বিতর্কের চর্চা জরুরি। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেবল আবেগ নয়, যুক্তিসম্মত মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্ক সেই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার চর্চা করে।

বিতর্কের প্রকৃতি ও গুরুত্ব: বিতর্ক একটি সুসংগঠিত যুক্তিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যম। এখানে দুটি পক্ষ থাকে একটি পক্ষে এবং একটি বিপক্ষে। উভয় পক্ষই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর তাদের যুক্তি তুলে ধরে। লক্ষ্য থাকে তথ্যনির্ভর ও যৌক্তিকভাবে নিজ নিজ অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা। বিতর্কে জিততে হলে কণ্ঠস্বরের জোর নয়, প্রয়োজন বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, তথ্যের সমৃদ্ধি এবং যুক্তির ধার।

আজকের বিশ্বের যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিতর্ক শিক্ষার্থীদের সেই যুক্তিশীল চর্চার মঞ্চ তৈরি করে দেয়। এটি একজন মানুষকে কেবল আত্মবিশ্বাসী করে তোলে না, তাকে সুশৃঙ্খল চিন্তাভাবনা, সম্মানজনকভাবে ভিন্নমত গ্রহণ এবং নিজ অবস্থানকে যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করার দক্ষতাও প্রদান করে।

বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ওয়েবিনার ভিত্তিক যুক্তিবিনিময় এবং ভিডিও ডিবেট সেশন প্রচলিত হচ্ছে। এতে দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউবের মাধ্যমে বিতর্ক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। তবে এর সাথে সাথে বাড়ছে তথ্য যাচাইয়ের গুরুত্ব। সঠিক তথ্য উপস্থাপন ও ভুয়া তথ্য থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চর্চাও বিতার্কিকদের করতে হচ্ছে।

বিতর্ক কোনো কণ্ঠকেন্দ্রিক শিল্প নয়, এটি মননকেন্দ্রিক এক জ্ঞানের যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে জয়লাভ হয় যখন যুক্তি, তথ্য, বিশ্লেষণ এবং আত্মবিশ্বাস একসাথে কাজ করে। একজন দক্ষ বিতার্কিক কেবল একজন বক্তা নন, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু, নেতৃত্বদক্ষ, যুক্তিশীল এবং সচেতন নাগরিক। বর্তমান সময়ে যখন আবেগ ও ভুল তথ্য সমাজকে বিভ্রান্ত করছে, তখন বিতর্ক পারে সেই সমাজকে আলোকিত করতে, যুক্তির আলো ছড়িয়ে দিতে। তাই আজকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্ক চর্চার বিস্তার একান্ত প্রয়োজন যে সমাজে বিতর্ক নেই, সেখানে অন্ধ অনুসরণ বাড়ে : যে সমাজে বিতর্ক দমন করা হয় বা নিষিদ্ধ থাকে, সেখানে একচেটিয়া মতবাদ, কুসংস্কার ও চরমপন্থা গড়ে ওঠে। সেখানে মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে না, যুক্তি খুঁজে বের করতে চায় না, কেবল অন্যের কথা অন্ধভাবে মেনে চলে। এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা দমন হয়।

অন্যদিকে, বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয় মুক্তচিন্তার মানুষ, যারা অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে জানে এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত যাচাই করতে পারে। তাই বিতর্কবিমুখ সমাজ কখনোই জ্ঞানভিত্তিক হতে পারে না।

আজকের জ্ঞাননির্ভর সমাজে বিতর্ক আর কেবল বক্তৃতার মাধ্যম নয়, বরং এটি যুক্তি, তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্যকে উদঘাটনের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। মতভেদ থাকলেও মত প্রকাশের শালীন ও যৌক্তিক এই লড়াই আমাদের চিন্তার বিকাশ ঘটায়, সহনশীলতা শেখায় এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে সুদৃঢ় করে। তাই বিতর্ক হওয়া উচিত একে অপরকে পরাস্ত করার নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে আলোকিত হবার চেষ্টা এক কথায়, এটি একটি নির্মল জ্ঞানের লড়াই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবাই ভালো থাকবার অভিনয় করছে
পরবর্তী নিবন্ধকবি মুদাসসীর আলীর দুটি অসাধারণ সৃষ্টি