পক্ষে বিপক্ষে নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে গঠিত বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি)-এর কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে গতকাল দেয়া এক রায়ে আলোচিত এই সংস্থার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে সিরিয়াল প্রথায় লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার লক্ষ্যে বিডব্লিউটিসিসি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর গঠন প্রক্রিয়াসহ সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ চলে আসছিল।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে অন্তত দশ কোটি টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং কাজে ব্যবহৃত লাইটারেজ জাহাজ চলাচল একই সিরিয়ালভুক্ত করার সিদ্ধান্তসহ বিডব্লিউটিসিসি গঠনের বিরুদ্ধে ১১টি কোম্পানি যৌথভাবে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। রিট পিটিশন নম্বর–১৩৪৭০/২০২৪। উক্ত রিট পিটিশনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বিবাদী করা হয়। বিচারপতি ফাতেমা নাজিব এবং বিচারপতি সিকদার মাহমুদুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ শুনানি শেষে ‘নৌপরিবহন অধিদপ্তর হইতে অনুমতি প্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর সমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা–২০২৪’ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই নির্দেশনার ফলে উক্ত নীতিমালার আওতায় গঠিত বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম মূলত স্থগিত হয়ে গেলো বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করে বলেছেন, এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত গমসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের পাশাপাশি ক্লিংকার, পাথর, সার প্রভৃতি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলোকে আর কোন ধরণের সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করতে হবে না।
সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত নানা ধরণের খোলা পণ্যবাহী মাদার ভ্যাসেল বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। এসব মাদার ভ্যাসেল বহির্নোঙরে অবস্থান করে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে। মাদার ভ্যাসেল থেকে খালাস করে এসব পণ্য দেশের অন্তত ৩৬টি নৌরুটে পরিবহন করা হয়। বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) সদস্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অন্তত ১৮শ’ বেসরকারি লাইটারেজ জাহাজ এই বিপুল পরিমান পণ্য পরিবহন করে। উপরোক্ত তিনটি সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহন করা হতো। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে পণ্য পরিবহন করলেও ডব্লিউটিসির বিরুদ্ধে জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, জাহাজ বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কার্যতঃ ভেঙে যায় ডব্লিউটিসি।
জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে বন্ধ হয়ে যায় সিরিয়াল প্রথা। গত প্রায় এক বছর ধরে জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকেরা নিজেরা দরকষাকষির মাধ্যমে ভাড়া নির্ধারণ এবং জাহাজ ভাড়া করে পণ্য পরিবহন করছিলেন। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হয় এবং জাহাজ ভাড়া তুলনামুলকভাবে অনেক কমে যায়। নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করলেও ভাড়া কমে যাওয়ায় সাধারণ জাহাজ মালিকদের অনেকেই চরম সংকটে পড়েন।
নতুন নীতিমালার আওতায় সিরিয়াল প্রথার বাধ্যবাধকতা নিয়ে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ প্রশ্ন তোলে। তারা নিজেদের পণ্য নিজেদের জাহাজ এবং ভাড়া করা জাহাজে নিজেদের মতো করে পরিবহন করতে চায়। কিন্তু বিডব্লিউটিসিসি শিল্প গ্রুপগুলোর নিজেদের মালিকানাধীন জাহাজগুলোকে ছাড় দিলেও ভাড়া করা জাহাজের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়। অর্থাৎ শিল্প গ্রুপগুলো ভাড়া করা কোন জাহাজে পণ্য পরিবহন করতে চাইলে সেগুলোকে অবশ্যই বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালভুক্ত হয়ে বরাদ্দ নিতে হবে। এতে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের কার্যক্রম ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। বিষয়টি নিয়ে তারা নানাভাবে দেন দরবার করেও কোন সুরাহা করতে না পেরে অবশেষে আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত সদ্য প্রণীত নীতিমালা ৬ মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।