বিডব্লিউটিসিসিতে যোগ না দেয়ার ঘোষণা চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের

সংকট নিরসনে নীতিমালায় সংশোধন চান । তিন সংগঠনের জরুরি সভা আজ

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিরোধ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারির পর আজ থেকে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকেরা সদ্য প্রণীত নীতিমালার সাথে ‘নেই’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তারা নীতিমালার বিভিন্ন ধারা উপধারার সমালোচনা করে বলেছেন, এগুলো সংস্কার করা না হলে আমরা এই কার্যক্রমে যোগ দেবো না। তারা বলেন, পতিত সরকারের প্রেসক্রিপশনে প্রণীত নীতিমালা জাহাজ মালিক কিংবা আমদানিকারকদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আজকের মিটিংয়ে যোগ দিয়ে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকেরা নীতিমালা সংশোধনের দাবি উত্থাপন করবেন বলেও জানিয়েছেন। এতে করে উচ্চ পর্যায়ের উদ্যোগের পরও দেশের লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে সংকট থেকে যাচ্ছে। আজ চট্টগ্রামে দেশের জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। এতে সদ্য প্রণীত নীতিমালার আওতায় গড়া মনিটরিং কমিটির প্রধান নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। আজকের বৈঠকের পরপরই নতুনভাবে গঠিত বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরুর কথা। তবে জাহাজ মালিকদের একাংশ নীতিমালা সংশোধিত না হলেও বিডব্লিউটিসিসিতে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় নতুন উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বন্দরের বহির্নোঙরে বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়। বেসরকারি মালিকানাধীন প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে এসব পণ্য পরিবহন করে। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) নিয়ন্ত্রণ করছিল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। ডব্লিউটিসির প্রবর্তিত সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে আমদানিকারকেরা জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করতেন। জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকাল এজেন্ট এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টে ডব্লিউটিসিতে দায়িত্ব পালন করতেন। কোনো কোনো লোকাল এজেন্ট আবার পণ্যের এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসির নিকট প্রয়োজনীয় জাহাজের চাহিদাপত্র প্রদান করে। ডব্লিউটিসি সিরিয়ালভুক্ত জাহাজ থেকে উক্ত পণ্যের এজেন্টের বিপরীতে বরাদ্দপত্র ইস্যু করে। লোকাল এজেন্ট জাহাজের যোগান দেয়। ভাড়া পরিশোধ প্রক্রিয়া পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসিকে পরিশোধ করে, ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্টের বরাবরে ভাড়ার টাকার চেক ইস্যু করে। জাহাজ মালিক লোকাল এজেন্ট থেকে ভাড়ার টাকা পেয়ে থাকেন।

ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি শুরুতে বেশ গ্রহণযোগ্য থাকলেও পরবর্তীতে নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে। জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, জাহাজ বরাদ্দ না দেয়া, ডেমারেজ এবং ডেসপাসের টাকা পয়সার নয় ছয়সহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে ডব্লিউটিসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জাহাজ মালিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিপুল অংকের টাকা আটকে থাকাসহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মুখে ভেঙ্গে যায় ডব্লিউটিসি। জাহাজ মালিকদের একাংশ ডব্লিউটিসির কারণে দুর্নীতি এবং বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে মর্মে অভিযোগ তুলে নতুন করে গঠন করে আইভোয়াক নামের পৃথক একটি প্লাটফর্ম। যেখান থেকে আমদানিকারকদের জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই কার্যক্রমও সফল হয়নি।

এতে করে সিরিয়াল প্রথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। জাহাজ মালিকেরা নিজেদের পছন্দ মাফিক ভাড়া যোগাড় করতে থাকেন, অপরদিকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমদানিকারকেরা দর কষাকষি করে প্রতিযোগিতামূলক দরে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ ভাড়া করতে শুরু করেন। এতে করে ডব্লিউটিসি থাকাকালে ঢাকা ক্লিংকার পাঠাতে টনপ্রতি ভাড়া দিতে হতো ৫৭৪ টাকা, প্রতিযোগিতামূলক দরে যা নেমে আসে ৪২০ টাকায়।

বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বৈঠক এবং নানাভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠক করে তৈরি করা হয় খসড়া বিধিমালা। পরে আরো যাচাই বাছাই করে ওই বিধিমালাকে ‘নৌ পরিবহন অধিদপ্তর হতে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা২০২৪’ শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়ন করে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

নবগঠিত বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরুর জন্য আজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনকে নিয়ে চট্টগ্রামে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়। মনিটরিং কমিটির প্রধান নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম এতে সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। সভার স্থান হিসেবে পুরোনো ডব্লিউটিসির অফিসের উল্লেখ করে চিঠিপত্র প্রদান করা হলেও জাহাজ মালিকদের একটি সংগঠনের আপত্তির মুখে গতকাল নতুন করে সীম্যান্স হোস্টেলের অডিটরিয়ামে সভা অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, আজ বৈঠকের পর থেকে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করা হবে। সিরিয়াল প্রথা প্রবর্তন করে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। তিনি এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সকল জাহাজ মালিক, আমদানি রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন। আজ বিকেল ২টায় অনুষ্ঠিত সভার পরই বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

কিন্তু চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) নীতিমালা সংশোধন করা না হলে বিডব্লিউটিসিসির সাথে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। আজকের বৈঠকে তারা নীতিমালার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এগুলোর সংশোধনের দাবি জানাবেন বলে জানিয়েছেন আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ। তিনি বলেন, এই বিধিমালার ব্যাপারে গত ১৬ জুলাই নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভার সভাপতি অতিরিক্ত সচিব মহোদয়কে আমি বিধিমালার অনেকগুলো অসংগতির কথা তুলে ধরেছিলাম। বারবার তুলে ধরার পরে মিটিংয়ের শেষের দিকে উনি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, বিধিমালা নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। কিন্তু সরকার পতনের পর তা আর হয়নি। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও গত ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে বলা হয়েছিল আরও দুই একটি মিটিংয়ে আলোচনা করার পরেই গেজেট হবে। কিন্তু তা না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিতর্কিত করতে গত সরকারের আমলে প্রণীত বিধিমালা নতুন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, আমরা চাই এই সেক্টরে সুশৃঙ্খলা ফিরে আসুক। তবেই সেই বিধিমালাটা হতে হবে আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিক উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য। একপেশে কোনো বিধিমালা কোনোভাবেই লাভজনক হবে বলে আমরা মনে করি না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আইভোয়াক মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, গত ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বিসিভোয়া, কোয়াব এবং আইভোয়াকের সভায় আইভোয়াকের পক্ষ থেকে জানানো হয় সরকার প্রদত্ত গেজেটের আলোকে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের মধ্যে পরিবহন দর, কর্ম পরিচালনা পদ্ধতি আগেকার আপত্তি ও ডিসপুটের নিষ্পত্তি এবং অন্যান্য বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেই নিরপেক্ষ ভ্যেনুতে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করা হবে। বিতর্কিত ডব্লিউটিসির কর্মপদ্ধতি এবং বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধিত না হলে আইভোয়াক এই কার্যক্রমের সাথে থাকবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগতকালও আইনজীবীদের বিক্ষোভ এজলাস থেকে নেমে যান বিচারক
পরবর্তী নিবন্ধনতুন কোনো সাংবিধানিক সংকট যেন না হয় : বিএনপি