হালদা নদীর কোল ঘেঁষে নিভৃত এক পল্লীর বুকে জন্মে ছিলেন একজন খুব সাধারণ একজন মানুষ নাম– বিজয় ভূষণ খাস্তগীর; যিনি আজীবন শিক্ষকতাকে ধ্যান–জ্ঞান করে সারাটি জীবন পার করে দিয়েছেন। সনদ অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২২ অক্টোবর। জন্ম ফটিকছড়ি উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে। পিতা মহিম চন্দ্র খাস্তগীর ও মাতা ঊর্মিলা খাস্তগীরের চতুর্থ সন্তান তিনি। হালদা নদীর ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করে বসতভিটার অস্তিত্ব রক্ষায় পুরো পরিবারকে সরে আসতে হয়েছে বহুবার। নদীর ভাঙন, বন্যা, পরিবারের নানা টানাপোড়েনের সাথে সংগ্রাম করে তাঁর বেড়ে ওঠার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাঁর লেখাপড়া করার যে একাডেমিক ক্যারিয়ার তা দেখলেই সহজেই বিষয়টি দৃশ্যমান হয়।
তাঁর শিক্ষা অর্জনের পথচলার গতি স্বাভাবিক ছিল না। কেন? সেটা তিনি প্রায়ই বলতেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা তাঁর শিক্ষার পথচলাকে ব্যাহত করতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে তিনি নাজিরহাট কলেজিয়েট হতে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। তখনকার সময় মেট্রিকুলেশন বলা হতো। বোর্ড ছিলো ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারি বোর্ড। মেট্রিকুলেশন পাস করার কিছুদিন পরই তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। শিক্ষকতার নেশায় পাওয়া এ মানুষটি তৎকালীন নানা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্য পেশায় জড়াননি। শিক্ষকতার এ মোহ নিয়ে সারাটি জীবন পার করেছেন।
পরবর্তীতে একসময় তাঁর সরকারি পোস্ট অফিসেও চাকরি হয়েছিলো কিন্তু গ্রাম পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় তিনি তা বিসর্জন দিয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি গ্রামের নানা সামাজিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ত থেকে একজন সাধারণ গ্রামের মানুষ হিসাবেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়েও সামাজিক নানা বিচার–আচারে স্থানীয় মেম্বার ইউপি চেয়ারম্যানরা তাঁকে সবসময় সম্মানের সহিত মূল্যায়ন করতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের পড়ালেখার বিষয়টিকেও তিনি গুরুত্ব দিতেন। চাকরিকালীন অবস্থায় প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে তিনি ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচ,এস,সি পাস করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসাবে ১৯৭৫ সালে বি,এ পাস করেন। এর আগে ১৯৬৫ সালে ইস্ট পাকিস্তান ডিভিশনাল ডিরেক্টর অব এডুকেশন চট্টগ্রাম থেকে সিইনএড ডিগ্রি নেন। লেখাপড়া শিক্ষকতা জীবন সংগ্রাম সব একসাথে চালিয়েছেন তিনি। দেশে উপজেলা পরিষদ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখায় তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদপত্রসহ স্বীকৃতি প্রদান করে। তাঁর গ্রামের পাঁচপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তিনি দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং স্বধীনতা পরবর্তী সময়ে হালদা নদীর ভাঙন থেকে স্কুল স্থানান্তরে অনেকের সাথে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অত্যন্ত সাদাসিধে চলাফেরা তিনি পছন্দ করতেন; নানা ধরনের আভিজাত্যের বিষয়কে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন। তাঁর বিভিন্ন সময়ের কথা বার্তায় উঠে আসতো জীবনে নানা ঘাত–প্রতিঘাত পেরিয়ে আসার কথা। পড়ালেখার যে পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি তা ভাবলে অবাক লাগে জীবনে কী কষ্টই না তিনি করেছিলেন। পড়ালেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁর তখনকার যৌথ পারিবারিক জীবনের নানা টানাপোড়েন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁর সংগ্রাম কখনো দারিদ্র্যের সাথে কখনোবা সমাজ কখনো বা পরিবারের সাথে। লেখাপড়ার কথা উঠলেই তিনি সবসময় বলতেন একজন মানুষের কথা যিনি বর্তমান কলকাতা প্রবাসী তাঁর বাল্যবেলার বন্ধু ডা. বিমল কৃষ্ণ খাস্তগীর। সেই বিমল কৃষ্ণ খাস্তগীর কলকাতার একজন নামকরা এমবিবিএস ডাক্তার। সেই ছেলেবেলায় পড়ালেখার জন্য তিনি সেই বাল্যবন্ধু বিমল কৃষ্ণ খাস্তগীরের বই ধার করে পড়তেন। এ কথা বলার সময় তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে বলতেন তাঁর বই না পেলে তাঁর শিক্ষা লাভ করাটা মোটেও হয়তো সম্ভব হতো না। সেই বিমল কৃষ্ণ খাস্তগীর বেশ কয়েক বছর আগে একবার বাংলাদেশে আসলে তাঁর স্মৃতি বিজরিত দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বেঁচে থাকা অনেক পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন তাঁকে নিয়ে। কলকাতা গিয়ে ‘ডাক্তারের ডাইরি’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন এবং তাঁর কাছে সেই বইয়ের একটি কপি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বাংলাদেশে ঘোরাফেরার সচিত্র অনেক প্রতিবেদন ছিল। গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষ নানা লেনদেনে তাঁকে সম্পৃক্ত রাখতে পছন্দ করতেন। বিভিন্ন চুক্তিপত্র, এলাকার সালিশী বিচারের নানা কাগজপত্র লেখার জন্য তাঁকে সবসময় সবাই অপরিহার্য মনে করতেন। বিশ্বস্ততায় তিনি ছিলেন সকলের অনুকরণীয়। গ্রামের একেবারে নিম্ন–মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু লোকের কাছে অসম্ভব এক বিশ্বস্ত মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরও অনেকের হৃদ্যিক ভালোবাসায় তার প্রমাণ মেলে। তিনি এক ধরনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তা তিনি আমাদের সকলকে মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। ঋণ গ্রহণ করাকে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। নিজের যা আছে তাতেই ছিলো তাঁর পরম সন্তুষ্টি। পরচর্চা বা পরনিন্দাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। সবচেয়ে ভালো যে অভ্যাস তাঁকে তাড়িত করতো তা হলো পড়াশুনার প্রতি অন্যের অনুরাগ সৃষ্টি এবং নিজের মধ্যে সঞ্চয় করার একটি প্রবণতা। স্কুলে শিক্ষকতাকালীন সময়ে একসময় তিনি রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করছে কিনা খোঁজ খবর নিয়েও আসতেন। তাঁর যৌথ পরিবারের অনেকেরই শৈশবের পড়া লেখা তাঁর হাত ধরেই। বহুছাত্রী তাঁর হাতে পড়ালেখা শিখেছে কোন অর্থের বিনিময় ছাড়া। সে সময় স্বল্প বেতনের চাকরি হলেও জীবন চলাতে তাঁর পরিমিতবোধ দেখে অবাকই হতে হতো। সঞ্চয়কে তিনি প্রাধান্য দিতেন এ কারণেই যে তিনি জীবনের দারিদ্র্যের কী নির্মম কষ্ট তা উপলব্ধি করেছিলেন মর্মে মর্মে। সে কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, সে কারণে নীতি–নৈতিকতায় থেকে সঞ্চয়কে তিনি প্রাধান্য দিতেন। অপরকেও তিনি একাজে উৎসাহ দিতেন বরং এজন্য অনেকেই তাঁকে ভুলও বুঝেছেন। গ্রামের অনেক অশিক্ষিত সাধারণ মানুষকে তিনি সঞ্চয় প্রবণতায় উৎসাহ দিতে ব্যাংক একাউন্ট কিংবা পোস্ট অফিসে একাউন্ট খুলতে সহায়তা বা পরামর্শ দিয়েছেন। পরিবারের অনেকেই তিনি এ পরামর্শ দিয়েছেন নিরন্তর। তিনি খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করা একজন মানুষ। সাদা পায়জামা ও সাদা পাঞ্জাবিই ছিলো তাঁর সারা জীবনের পোশাক। কখনো শার্ট কিংবা রঙিন কোনো পোশাকে তাঁকে দেখা যায়নি। হিসাব নিকাশে তিনি সবসময় স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ ছিলেন। অনেক বিশ্বাসী মানুষের সাথে তাঁর লেনদেন ছিলো। কেউ কখনো তাঁর সম্পর্কে সে বিশ্বাসে প্রশ্ন তুলতে পারেননি বেঁচে থাকা অবস্থায় কিংবা মৃত্যু পরবর্তীকালীন সময়ে। অত্যন্ত গোছালো পরিচ্ছন্ন জীবন ছিলো তাঁর। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর সমস্ত সার্টিফিকেট অত্যন্ত সযত্নে গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
শিক্ষকতা জীবনের চারদশকের বেশি সময়ের অধিকাংশ সময় ছিল তাঁর প্রধান শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতা জীবন এবং শিক্ষক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৬ এর ২২ অক্টোবর তিনি অবসরে যান এবং তাঁর খুব প্রিয় দিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিন ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান। এবার তাঁর দশম প্রয়াণ দিবস। অবদান স্বীকার করেই মানুষ বড় হয়। বিজয় ভূষণ খাস্তগীর একজন সহজ সরল নিরেট সফল পরোপকারী দায়িত্বশীল শিক্ষকেরই প্রতিচ্ছবি।
লেখক : বিজয় ভূষণ খাস্তগীরের সন্তান, সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম। প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক।