বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। অহংকার, গৌরবের মাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম সোনালি সময়। হাজার বছর ধরে বাঙালির যে আকুতি ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতার এ মাসে তা অর্জিত হয়। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সূত্র ধরে ১৯৬৯ এর গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তীতে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রায় ৯১ হাজার ৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।
বিজয়ের এ মাসে অবশেষে চলে গেলেন গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদি। যে কোন প্রতিভাবান তরুণের অকাল মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি, সম্ভাবনার অপমৃত্যু। তারুণ্য যেমন শক্তি, তেমনি তারুণ্যের অপচয় কাম্য নয়। হাদীর মৃত্যুর পরবর্তীতে হাদীর মৃত্যুকে সামনে রেখে সংবাদপত্র অফিসে আগুন, ছায়ানট, উদীচী সহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ও ভাংচুরের ঘটনাও ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে তারুণ্য শক্তি উঠে এসেছে, এক সুসংগঠিত করে দেশপ্রেমের শক্তিতে জাগড়িত করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা দরকার।
বিজয়ের অনুভূতি সব সময়ই আনন্দের হয়ে থাকে। তবে একই সঙ্গে বেদনারও। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে আমার ভাইয়ের আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য শহীদদের রক্ত ও সম্ভ্রম হারানো মা–বোনদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তাঁদের রক্তে ও অবদানে মুক্ত হয়েছিল স্বদেশ। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন সাধারণভাবে বাঙালি জাতির জন্য পরম গৌরবের। এ দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি সার্বভৌম দেশের নাম চিরকালের জন্য একে দিয়েছে বাংলার মানুষ। সমগ্র বিশ্বেবর কোনো জাতি এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তিসংগ্রামে বিজয় অর্জন করেনি।
যে কোনও গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা মানুষই স্বীকার করবেন যে, একটি সরকারের বা কোনো দলের নিয়ন্ত্রিত পথেই কেবল রাষ্ট্রের পরিচালনার নির্দিষ্ট হতে পারে না। এ রকম চিরন্তন বিধিলিপি কোথাও নেই। এমন ব্যবস্থা বা পদ্ধতি গণতান্ত্রিক নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র নিপীড়ত হলে, গণমানুষের আস্থা হারালে সময় ও যুগের বিবর্তনে সরকারের পরিবর্তন ঘটে এবং নীতিরও রূপান্তর ঘটে। দেশের বৃহত্তর মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সে পরিবর্তন গ্রহণ করলে তা স্থায়ীত্ব লাভ করে। কিন্তু জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস ও কি কখনো পরিবর্তন হয়, না তা সম্ভব? যদি ইতিহাসকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়, বিকৃত করার চেষ্টা হয় তাহলে তা ক্ষমাহীন অপরাধের তুল্য হয়। এতে রাষ্ট্রকেই অস্বীকার করা হয়।
ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছিল সে সময় তা বিনষ্ট হয়েছে শুধুমাত্র নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় অভাব এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে। দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বীজ বপন করা হয় তার ফলে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পাকিস্তান। পৃথিবীর কোথায় ও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ প্রতিষ্ঠা হয়নি। যদি হতো তাহলে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি মুসলিম ধর্মালম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল মিলে একটি মুসলিম দেশ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া মিলে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ হয়নি তেমনি ভারত নেপাল মিলে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেশ হয়নি। আবার এক ধর্মের মধ্যেও নানা অংশ যেমন শিয়া, সুন্নী, ওয়াহাবী, আহমদীয়া–ক্যাথলিক, প্রটেষ্টান্ট, হীনযান, মহাযান ইত্যাদি ইত্যাদি ভিন্ন ধারার মতে বিভক্ত।
একটি দেশের জন্য প্রয়োজন ভূখণ্ডগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক বন্ধন, ভাষা, অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতির প্রয়োজন হয়। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রাম ছিল দীর্ঘসময়ের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।
মুক্তিসংগ্রামে ঘোষণা করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দীপ্ত অঙ্গীকার। এ লক্ষ্য অর্জনে গ্রাম–শহরের শ্রমজীবী মানুষ, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মধ্যবিত্ত নেমে এসেছিল আন্দোলন, অভ্যুত্থান আর স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে। সকল পথ যেন সে সময় মিশে গিয়েছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এবং স্বাধীনতার মোহনায়।
কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৫ বছরে চাওয়া এবং পাওয়ার মাঝে বিস্তর ফারাক লক্ষ্যণীয়। স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল যারা আর সুফল ভোগ করছে যারা তারা একদেশের মানুষ হয়েও যেন এক জাতের মানুষ নয়। দু’জন বাঙালি কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে আজ ১ লাখ ২৭ হাজারের বেশি কোটিপতি, অন্যদিকে দেশে ৭ কোটি ৫০ লাখ শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বিশ্বের সবচেয়ে কম। ১ কোটি ৫৯ লাখ শ্রমজীবী মানুষ বিদেশের বাজারে। বেকারত্ব আজ তীব্র আকার ধারণ করছে। যে কোন কাজ পাওয়ার জন্য যুবকরা মরিয়া হয়ে জীবনের ও আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে বিপদসংকুল ও অনিশ্চিত পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কৃষক ধান, সব্জি, মাছ, ফল চাষ করে ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম দিনদিন বেড়েই চলেছে। শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যয় ক্রমাগত হারে বাড়ছে। ভোটের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দুটোই আজ বেড়েছে। ক্ষমতার স্বার্থে এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈষম্য আর দুর্নীতি সবই বেড়েছে।
মানবিক মর্যাদা যে ভুলুণ্ঠিত তা নারীর লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংখ্যালঘু জাতি সত্তার ওপর আক্রমণের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং চর্চা এখন সবচেয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে। নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ না করে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধ ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে।
আজকে আমাদের বিবেকে যে প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়, স্বাধীনতার পর যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ফলেই শোষণ ও বৈষম্য এত প্রকট রূপ নিয়েছে। এ কারণেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি কিন্তু শোষণের প্রাপ্তি ঘটেছে ব্যাপক। শোষণ ও লুণ্ঠনকে অব্যাহত রাখতেই নিপীড়ন যেমন বেড়েছে শোষককে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক উন্মদনাও তেমনি প্রশ্রয় পাচ্ছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রাপ্তিও ঘটেনি এ কথা বলাই শুধু যথেষ্ট নয়, কারণ দূর করা এবং অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামটাও এখন খুবই জরুরি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বেড়েছে দারিদ্র, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। সাধারণ মানুষ একদিকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, অন্যদিকে ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। এ রকম রাষ্ট্র কখনোই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র হোক যেখানে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।












