বিজয়ের দীপ্ত দিনে স্বাধীনতার নতুন উচ্চারণ

আমেনা শাহীন | মঙ্গলবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

১৬ই ডিসেম্বরবাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল, অনির্বাণ আলোক শিখা। এ দিন দীর্ঘ নয় মাসের ত্যাগ, তিতিক্ষা রক্ত ক্ষয় অনেক প্রাণের বিনিময়ে কুয়াশার কাফন চিরে উদিত হয়েছিল বিজয়ের রক্তিম সূর্য। এ দিন শুধু বিদেশী বেনিয়াদের সামরিক পরাজয়ের দিন নয় বরং এক জাতির আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দিন, বঞ্চনা, নির্যাতন ও অন্ধকার পেরিয়ে স্বপ্নের আলোকিত প্রভাত লাভের দিন।

৯ মাসের রক্তক্ষরণ, ক্ষুধা, অগ্নি ও অশ্রুর পথ পাড়ি দিয়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তার প্রতিটি রেখা যেন ধুলোয় লেখা এক অক্ষয় কবিতা। বুকে সাহস আর অস্ত্রে বিশ্বাস নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রচনা করেছেন এমন এক ইতিহাস, যা কোনো গ্রন্থে সীমাবদ্ধ নয়তা শিকড় হয়ে আছে বাংলার মাটিতে, বাতাসে, নদীতে, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে।

১৯৭১ সালের এই তারিখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তাই এই দিনটি আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে গভীরভাবে খোদিত, গৌরবের চিহ্ন হয়ে।

বিজয়ের এই দিনকে উপলব্ধি করতে হলে ফিরে যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তঝরা পথচলার দিকে। ৯ মাসের যুদ্ধ ছিল শুধু অস্ত্রের সংঘর্ষ নয়, এটি ছিল আত্মপরিচয়, ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম। বাঙালির ইতিহাসে এই যুদ্ধ এক মহাকাব্যযেখানে গ্রামশহর, কৃষকশিক্ষার্থী, শ্রমিকনারীধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

৩০ লক্ষ শহীদের আত্মবলিদান এবং অসংখ্য মাবোনের অবর্ণনীয় ত্যাগেই আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতাএ বিজয় যা আমাদের মানচিত্র, আমাদের পতাকা এবং আমাদের অস্তিত্বকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে।

১৬ ডিসেম্বরের বিজয় বাংলাদেশের জন্য ছিল এক মহাপুনর্জন্ম। এই দিনটি ঘোষণা করেআমরা বাঙালি, আমরা স্বাধীন, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে নির্মাণ করার ক্ষমতা রাখি। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠার এই মুহূর্তটি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার নয়, এটি ছিল সংস্কৃতি, ভাষা ও চেতনার মুক্তি।

বিজয় দিবস তাই প্রতীক একটি আত্মমর্যাদার, একটি স্বাধীন স্বপ্নের, যার আলো এখনও সমান ভাবে দীপ্তিমান।

বিজয়ের আনন্দ অসীম, তবে তার সঙ্গে যুক্ত আছে দায়িত্ব ও দেশগঠনএর চিরন্তন আহ্বান। বিজয়ের ৫৩ বছর পরও আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের যেভাবে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল, বাংলার দামাল ছেলেরামুক্তিযোদ্ধারা যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিল তাদের সে স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। কিন্তু আমরা হতাশাবাদী নই সমৃদ্ধ, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আজও আমরা এগিয়ে চলেছি।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধএগুলোকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কর্তব্য। আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না, আমাদের পূর্ব পুরুষরা সেটা করে গেছেন শুধু যার যার জায়গা থেকে দেশের ভালোর জন্য কাজ করে যেতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে সবকিছু থেকে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে দেশ কে প্রাধান্য দিতে হবে, দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে যেতে হবে, তাহলেই বিজয়ের লক্ষ অর্জিত হবে।

১৬ই ডিসেম্বর তাই শুধু স্মৃতির দিন নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞার দিন। অতীতের ত্যাগ থেকে শক্তি নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে রূপ দেয়ার দিন। দেশ থেকে অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার, অনৈতিকতা, বর্বরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও জাতি বিনির্মাণ করে বাংলাদেশ কে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দুর্বার শপথ নেয়ার দিন।

বিজয় দিবস আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়অত্যাচার যতই প্রবল হোক, ন্যায় ও সত্য শেষ পর্যন্ত বিজয়ের পতাকা তোলে। এটি আমাদের জাতীয় চেতনার অনন্ত আলোকশিখা, যা নেভে না কখনো। প্রতি বছর এই দিনে আমরা আবারও অনুভব করিস্বাধীনতার পতাকা বিজয়ের পতাকা একটি কেবল কাপড় নয়, এটি এক জাতির অহংকার এবং আত্মার প্রতীক। ১৬ই ডিসেম্বর তাই কেবল বিজয়ের স্মারক নয়, এটি এক জাতির গৌরব, সাহস, আত্মত্যাগ ও অদম্য স্বপ্নের চিরন্তন উচ্চারণ।

লেখক : অধ্যক্ষ, চিটাগাং আইডিয়্যাল হাই স্কুল, চট্টগ্রাম; পরিচালক, চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডান থেকে বামে
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের বিজয় আমাদের অর্জন