বিজয়ের চেতনা আর টেকসই ভবিষ্যতের পথ

ড. মো. আহসানুল হক রোকন | সোমবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ও অবিস্মরণীয় অর্জন। হাজার বছরের দাসত্ব, প্রবঞ্চনা, বঞ্চনা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক বেদনা এবং মানবিক মর্যাদার অবমাননা বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে আঘাত করে এসেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আরোপিত শোষণনির্যাতন, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর অন্যায্য আক্রমণ, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতি, মৌলিক অধিকার হরণ এবং বাকস্বাধীনতা দমন এ দেশের কোটি মানুষের মনে স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছিল। বঞ্চনার এই কঠিন বাস্তবতা ধীরে ধীরে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়, যা শেষ পর্যন্ত জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের উত্তাল সময়ে আপামর জনসাধারণ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ছিল কেবল একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়; এটি ছিল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষা, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক অধিকার পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ। দীর্ঘ লড়াই, অসংখ্য ত্যাগ ও চরম আত্মদান শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি এ বিজয় শুধু রাজনৈতিক মুক্তিই নয়, জাতির আত্মপরিচয়ের এক নবসূচনা।

বিজয় দিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, তৎকালীন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সাহসী সেক্টর কমান্ডারসহ সকল শহীদকে, যাদের ত্যাগ ও সাহসিকতার বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাদের অদম্য মনোবল, অবিচল দেশপ্রেম এবং ত্যাগের মহিমা আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে করেছে গৌরবমণ্ডিত।

মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকারতম অধ্যায় ছিল ২৫ মার্চের কালরাত্রি, যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নেমে এসেছিল দানবীয় হত্যাযজ্ঞ। সেই ভয়াল সময়ের মধ্যেই কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে উচ্চারিত স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতিকে আরো দৃঢ়সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা সারা বাংলায় প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং লাখো মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। স্বাধীনতার স্বাদ মানে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়; এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সমতার নিশ্চয়তা এবং মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা জড়িত। কিন্তু এখনো সমাজে বৈষম্য, অনাচার, অত্যাচার ও বাকপরাধীনতা টিকে আছে। গণতন্ত্রের চর্চা অনেক সময় জনস্বার্থে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না; টেকসই উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য যে সুসংগঠিত ভিত্তি প্রয়োজন, তা এখনও দুর্বল অবস্থানে রয়ে গেছে।

এর পাশাপাশি নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার অবক্ষয় আমাদের সমাজব্যবস্থাকে নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শিক চর্চার অভাব উদ্বেগজনক। মানসম্মত শিক্ষক সংকট, শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা, অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতির অনুপস্থিতি এসবই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ, নৈতিক ও প্রগতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে একটি সুস্থ, সক্ষম এবং উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।

তারপরও আশার আলো নিভে যায়নি। জনগণ এখনো টেকসই গণতন্ত্র, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং যোগ্য, নৈতিক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব কামনা করে। মানুষের এই প্রত্যাশা প্রমাণ করে যে জাতি হিসাবে আমরা এগিয়ে যেতে প্রস্তুত শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত এবং সম্মিলিত প্রয়াস।

একটি সফল রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে আবেগের পাশাপাশি বাস্তবতা ও যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা জরুরি। সঠিক সমন্বয়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি, পরিশ্রম, সুশাসন এবং ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি।

এই ৫৪তম বাংলাদেশ বিজয় দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই দেশ, এই বিজয়, এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে কোটি মানুষের ত্যাগ ও স্বপ্ন। তাই আমাদের অঙ্গীকার হোক: ‘এই ৫৪তম বাংলাদেশ বিজয় দিবসে, আসুন আমরা সততা, ঐক্য এবং সৎ কাজের আলোকে পরিচালিত হই।’ এই প্রতিজ্ঞাই আমাদেরকে একটি ন্যায়সঙ্গত, মানবিক, সুশাসিত এবং টেকসই বাংলাদেশের পথে এগিয়ে নিতে পারে।

লেখক: পরিচালক, ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট, সিভাসু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদ্যালয় হোক প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের বিজয়গাথা
পরবর্তী নিবন্ধউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা অধ্যক্ষ সৈয়দ শামসুল হুদা (রহঃ)