দিনটির নাম বিজয় দিবস। গৌরব উজ্জ্বল দিন। তার চেয়ে বেশি গৌরবোজ্জ্বল দিনের নাম স্বাধীনতা দিবস। এ দুটি দিন জাতির কাছে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং ষোলই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দেয়। প্রায় তিন লাখ নারী সম্ভ্রম হারায়। এ যুদ্ধটি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের সাথে সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধ। এটি একটি অসম যুদ্ধ। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে জনযুদ্ধ। এককথায় সাধারণ মানুষের মুক্তির যুদ্ধ; মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপামোর জনগণ এ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধ করে। স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এর চেয়ে গৌরবজ্জ্বল অর্জন আর কি হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধই এ জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ যুদ্ধের বিজয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ কোনো যুদ্ধ নয়। সীমানা বিরোধের যুদ্ধ নয়। অমীমাংসিত বিষয়ের যুদ্ধ নয়। ভূখণ্ড দখলের যুদ্ধ নয়। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতির স্বাধীনতার যুদ্ধ। একটি দেশের সার্বভৌমত্বের যুদ্ধ। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। নৃশংশ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের যুদ্ধ। গণহত্যার বিরুদ্ধে জনতার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নির্যাতিত নিপীড়িত শোষিত মানুষের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ কোন বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর যুদ্ধ নয়। সর্বস্তরের মানুষের যুদ্ধ, গণযুদ্ধ। কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতার যুদ্ধ। সকল শ্রেণি পেশার মানুষের যুদ্ধ। অধিকার আদায়ের এ যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। শোষণ বাঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর আক্রমণ চালালে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে মুক্তিসংগ্রাম ওতোপোতোভাবে জড়িত। মুক্তিসংগ্রামের পথ বেয়ে জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম দিক মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে মানুষের মুক্তি। বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করা, যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সোপান। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য একইসাথে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এর অন্যতম লক্ষ্য। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। জেল জুলুম নির্যাতন বন্ধ করা, হত্যা ধর্ষণের মতো জগন্যতম অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা। সর্বোপরি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ সবইতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠী ভেদে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনা হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রান মান উন্নয়নে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হবে। মানুষদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাভলম্বী করে তোলা হবে। শিক্ষাকে সার্বজনীন করা হবে, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়া হবে। স্বাধীন দেশে কোন মানুষ বঞ্চিত হবে না। এসবই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার।
সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিলেও তরুণদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষিত অশিক্ষিত ছাত্র তরুণরা সবার আগে সাড়া দেয়। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে তারা মুক্তিযুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ে। একইসাথে যুবকরাও যৌবনের শক্তি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কোনো বাধা বা ষড়যন্ত্র তাদের আর রুখতে পারেনি। সব ধরনের অপশক্তিকে যুবক আর তরুনরা পদদলিত করে এগিয়ে চলে। তারুণ্য আর যুবশক্তির জোয়ারে মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন মাত্রা পায়। এর সাথে যুক্ত হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধরা, মধ্য বয়সী তরুণ দুঃসাহসী প্রৌড়, সাহসী মানুষেরা। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই যোগ দেয়। নারীরাও পিছিয়ে থাকেনি। রণাঙ্গনে সহযোদ্ধার মতো যুদ্ধ করে। পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে। আহত মুক্তি যোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করে, সাহস যোগায়। প্রতিটি গ্রাম প্রতিটি পাড়া মহল্লা শহর বন্দর মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে যায়। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেয়। এখান থেকে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধরা শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার এ মাটি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য পূরণ হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সভা সেমিনারে উচ্চারিত হয়েছে কিন্তু এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের মাঝে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে সেখানে মানুষের অধিকার সংরক্ষিত হয়নি। বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকে। শোষণ বঞ্চনা থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারেনি। বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দমন পীড়ন হিংসা হানাহানি সংঘাতের বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যখন যারাই ক্ষমতায় আসে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে মানুষের অধিকারকে ভুলুণ্ঠিত করে। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সাম্য ন্যায়বিচার মানবিক মূল্যবোধ তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। আইনের শাসন কায়েমের প্রুতিশ্রুতি দিলেও তার ধারে কাছে যায়নি। এ দায় যারা শাসন ক্ষমতায় এসেছে তাদের। এ ব্যর্থতা শাসক গোষ্ঠীর যারা দেশ পরিচালনা করেছে।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশের মানুষের ভাগ্য এভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে না। ন্যূনতম মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয় না। মানুষ কথা বলতে পারে না। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। তার অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন না হওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈপরিত্যে অবস্থান নেয়া। যা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। এ জন্য দায়ী শাসকরা। সাধারণ জনগণ বার বার রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষ রক্ত দিয়েছে। চব্বিশের ছাত্র–জনতার গণ অভ্যুত্থানে মানুষ রক্ত দিয়েছে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তার অন্যতম লক্ষ্য মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বৈষম্যের অবসান ঘটানো। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, সুশাসন কায়েম করা। যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। এগুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলে মানুষ বার বার রাজপথে নেমে এসেছে, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় জাতির শ্রেষ্ঠ গৌরবগাথা। এ যুদ্ধের বিজয় স্বাধীনতার বিজয়, সার্বভৌমত্বের বিজয়। গৌরবোজ্জল এ বিজয় যুগের পর যুগ সমুজ্জ্বল। এ বিজয় থেকে কেউ দূরে সরে যেতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধকে পাস কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। শতাব্দী পর থেকে শতাব্দী মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে প্রেরণা যোগাবে, পথ দেখাবে, শক্তি আর সাহস যোগাবে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস, অকুতোভয় সৈনিকের সাহস। এ বিজয়ের মাঝে আছে দূরন্ত কিশোরের অসীম সাহসিকতা, উদ্দীপ্ত তরুণের নির্বিকতা, যুবকের অপরিমেয় শক্তি, প্রৌঢ়ের অবিচল বিচক্ষণতা, ষাটোর্ধ্ব মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা। এর সাথে মিশে আছে লাখো শহীদের রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হারানোর মর্মবেদনা, বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ চিরঞ্জীব, চির অম্লান, চির উন্নত শির। মুক্তিযুদ্ধের জয়গান তারুণ্যের গান, যৌবনের গান, বিজয়ের গান। এ গান অবিনশ্বর, অনন্তকাল বহমান।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।












