সাহিত্য হল সাহিত্যিকের মনের আয়না। তাঁর মানসস্বরূপ ধরা পড়ে এ–আয়নাতে। লেখকের এই মানসস্বরূপ গড়ে ওঠে তাঁর পরিবার,পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিক্ষা–দীক্ষা, পঠন–পাঠন, স্মরণ–মনন, ধ্যান–অনুধ্যান, এবং সর্বোপরি তাঁর সমকালের প্রভাবে। এটা একটা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যা রাতারাতি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। লেখকের, বিশেষ করে কবি আর কথাশিল্পীদের সৃষ্টিতে তাঁদের সেই মানসিক গড়নটার ছাপ পাওয়া যায়, যা পাঠককে ভালো বা খারাপ লাগায়, তাকে প্রভাবিত করে, এবং উদ্দিষ্ট কবি বা কথাশিল্পীর রচনার প্রতি তাকে আকৃষ্ট বা বিমুখ করে তোলে।
কথাগুলো মনে এলো আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র সদ্যপ্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বিজিত জ্যোৎস্নার দাহ’ পড়তে গিয়ে। পিন্টুকে আমরা গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চিনি সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনে জড়িত ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে নিমগ্ন একজন গবেষক হিসেবে। সেইসাথে তিনি চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক পূর্বকোণ’–এর ‘শিল্পসংস্কৃতি’ পাতাটি সম্পাদনা করে আসছেন সেই ১৯৮০’র দশক থেকে। পেশা ও নেশাগত এসব ব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি কিছু কিছু গল্প–কবিতাও লিখেছেন, যেগুলো পূর্বকোণ আর অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গল্পগুলোর মধ্য থেকে বেছে নেয়া আটটা গল্প এ–বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। গত শতকের শেষার্ধ আর চলতি শতকের শুরু পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বছরব্যাপী পিন্টু’র জীবনকালের চট্টগ্রাম শহর আর বাংলাদেশের বহির্জগৎ আর অন্তর্জগতের এক নিপুণ প্রামাণ্যচিত্র পিন্টু’র এ গল্পগ্রন্থটি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটির নামগল্প ‘বিজিত জ্যোৎস্নারাহ’ জায়গা পেয়েছে সবশেষে। অন্তর্ভুক্ত বাকি সাতটা গল্পের মুদ্রণক্রমিক নাম: ‘সামনে অন্ধকার’, ‘আগন্তুক’, ‘উপহার’, ‘প্রকৃত প্রকৃতি’. ‘রিক্ত সুখ’, ‘সুখ পলাতক’ এবং ‘চিলেকোঠার পৃথিবী’। প্রায় সবক’টা গল্পের মূল উপজীব্য প্রেম,প্রাপ্তবয়স্ক নর–নারীর ভালোবাসা। তবে তার পাশাপাশি এসেছে আমাদের সমাজজীবনের মর্মান্তিক কিছু অসঙ্গতি, নৃশংসতা আর অবিচারের ইতিবৃত্তও। নারী–পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কে টানাপোড়েন, বিশ্বাস–অবিশ্বাসের দোদুল্যমানতা, স্বীকৃতির আনন্দ আর বিশ্বাসভঙ্গের বেদনার নানা দিকও উন্মোচিত হয়েছে পিন্টুর কুশলী কলমে।
বইটির সর্বপ্রথম গল্প ‘সামনে অন্ধকার’–এ আমাদের পুলিশ–প্রশাসনের এক মসিলিপ্ত অধ্যায়ের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে, যার সম্পর্কে আমাদের সকলের না হলেও অধিকাংশেরই একটা বাস্তব ধারণা আছে, যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করে নিরুপদ্রবে জীবন কাটিয়ে দেয়ার কাপুরুষোচিত ভান করে বেঁচে থাকি ক্লীব কীটাণুকীটের মতো। ‘সার্থকনামা’ গল্পটি এ বইখানা পাঠের সূত্রপাতেই এক গভীর অন্ধকারে আমাদের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
এর পরের ‘আগন্তুক’ গল্পটিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সুসংবদ্ধ ভাষায় বিবৃত হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের আরেকটি জ্বলন্ত নাটকীয় অধ্যায়। এ গল্পে একান্ত বাস্তবনির্ভর একটি কল্পিত চরিত্র আমাদের নির্ঝঞ্ঝাট পারিবারিক জীবনে আবির্ভুত হয় বহুকালের চেনা হয়েও আজ অচেনা এক আগন্তুকের মতো, এবং যার করুণ পরিণতি পাঠককে এক গভীর বিষণ্নতায় নিমজ্জিত করে।
বইটির তৃতীয় গল্প ‘উপহার’ আবর্তিত হয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও কোচিং বাণিজ্যের এক নির্মম কালো দিক নিয়ে, যা আমরা জানলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলি না। এ গল্পের উপহার হল আসলে একধরনের উপঢৌকন বা উৎকোচ, যা অভিভাবকরা সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে দিতে বাধ্য হন তাঁদের সন্তানদের তথাকথিত সুশিক্ষার স্বার্থে, যা যোগাতে গিয়ে প্রাণান্ত হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত অভিভাবকদের, সৃষ্টি হয় অনেক করুণ শোকাবহ পরিস্থিতির।
চতুর্থ গল্প ‘প্রকৃত প্রকৃতি’–তে উন্মোচিত হয়েছে মানুষের ভেতরকার আসল স্বরূপ, যা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে তার বয়স আর অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে। তারুণ্যের, যৌবনের জোয়ারে নদী যখন জলে কানায় কানায় ভরা, তার তলদেশ আমাদের তখন চোখে পড়ে না। তারপর একদিন যখন ভাটি নামে, তখন দৃশ্যমান হয় তার শৈবাল আর উপলাকীর্ণ বন্ধুর তলদেশ, মাছেদের সঞ্চরণ, নদীর যত গোপন সম্পদ আর সঞ্চয়। পরিণত বয়সে পৌঁছে এ–গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র প্রবীণা আনোয়ারার উপলব্ধি, “এসব আবরণ একটার পর অরেকটা সরে গিয়ে একটা মজা হয়েছে তাই না? জীবন অনেকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।”
পঞ্চম গল্প ‘রিক্ত সুখ’ এক নিঃসন্তান দম্পতি সাহেদ–ফরিয়ার কাহিনি। তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছে, কিন্তু অনতিদীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তাদের অনেক কামনা আর চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। ছেলেপুলের ঝামেলা না থাকায় তাদের ঘরদোর সবসময় ছিমছাম, টিপটপ থাকে। বাড়তি কো ঝামেলাও তাদের পোহাতে হয় না। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট সুখী জীবন। ‘আমরা ভালো আছি’– এ কথাটাই যেন এক শাশ্বত ঋতুচক্রের মতো সাহেদ ও ফরিদার সংসারে ঘুরে চলেছে।” কিন্তু এটাই কি প্রকৃত সুখ! এক পর্যায়ে ফরিদার ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সন্তান নিয়ে নানা সমস্যাক্রান্ত অথচ সন্তুুষ্ট জীবনযাপন দেখে সাহেদ–ফরিদার বুক অমন চিনচিন করে কেন? “দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের দাম্পত্য জীবনে সুখ শব্দটা এমন নিবিড়তায় তাদেরকে ঘিরে আছে যে, বাইরের রোদ, বৃষ্টি কিছুই লাগতে দেয় নি। ধুলোমাটির সামান্য স্পর্শও না। সংশয়ে ফরিদার গলা কেঁপে উঠল– ‘আচ্ছা, সুখেরও তো অসুখ হতে পারে, পারে না?” এ সংশয় প্রকাশের মধ্যে দিয়ে গল্পটা শেষ হয়েছে।
‘সুখ পলাতক’ নামের ষষ্ঠ গল্পটি সুখী আর বিশ্বস্ত দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বাসের কীট সঞ্চারের কাহিনি। স্বামী কেশবের জীবনে দ্বিতীয় নারীর আবির্ভাব ঘটেছে, এ বোধ স্ত্রী ছায়াকে এক গভীর হতাশার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে থাকে। অথচ এ ব্যাপারে তার হাতে কোনো নিশ্চিত প্রমাণও নেই। তবুও সন্দেহের ঘুনপোকা তাকে কুরে কুরে খায়। “ঠিক বুঝতে পারে না ছায়া। ঘরের সবকিছুই আগের মতো ঠিকঠাক আছে। জবা কিছুই নিয়ে পালায় নি। তবুও যেন ছায়ার সর্বস্ব খোয়া গেছে জবার হাতে।”
বইয়ের সপ্তম গল্প ‘চিলেকোঠার পৃথিবী’ এক হারানো প্রেমের কিছু মাধুর্য আবারো কিছুুটা ফিরে পাওয়ার কাহিনি। সুবর্ণাকে ভালোবেসেও জীবনসঙ্গিনী করতে পারেনি হাসান। তার একদার প্রেমিকা আজ অন্য লোকের স্ত্রী। শুধু প্রেমের ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের আরো অনেক ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতাকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সে। কিন্তু এক বর্ষণক্লান্ত দিনে নিজের হৃদয়ের মতোই মেঘলা আকাশের নিচে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা তাকে মুখোমুখি আরেক বাড়ির ছাদের চিলেকোঠা থেকে তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটি তাকে যে বিশাল প্রাপ্তিতে ভরিয়ে দিল, তাতে হাসানের মনে হল: “কিছুই হারিয়ে যায় নি হাসানের। সবকিছুই সেই আকাশের মতো। সেই থরোথরো মেঘ, সেই পাগল করা বৃষ্টি, সেই চিলেকোঠা, আর তার সুবর্ণা…।” দারুণ সুন্দর এক মিষ্টি প্রেমের গল্প এটি।
বইটির সর্বশেষ তথা নামগল্প ‘বিজিত জ্যোৎস্নার দাহ’ এ বইয়ের বৃহত্তম গল্পও বটে। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র জ্যোৎস্নার নামাঙ্কিত গল্পটি এক অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আর ব্যবচ্ছেদের গল্পও বটে। নারীর যৌবন আর সৌন্দর্য চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায় তার মাতৃত্বের মধ্যে। কিন্তু জ্যোৎস্নার প্রেমিক স্বামী ইমরান তাকে সন্তানবতী করতে ব্যর্থ হলে জ্যোৎস্না যেন প্রতিশোধকামী হয়েই স্বামীর বন্ধু জাফরের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। তারপর তা নিয়ে সৃষ্ট নানা জটিলতা আর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গল্পটা এগিয়ে গেছে, যা পাঠককে এক ঘোর আর সত্য অনুভবের গভীরে নিয়ে যায়।
‘বিজিত জ্যোৎস্নার দাহ’ গ্রন্থের গল্পগুরো মূলত চট্টগ্রাম শহরের প্রেক্ষাপটে রচিত। চট্টগ্রামের পাঠকরা এসব গল্পে তাঁদের প্রিয় বা অপ্রিয় শহরটাকে নতুন করে খুঁজে পাবেন। আমাদের মতো পিন্টুর প্রায় সমবয়সী যাঁরা আছেন, তাঁরা এসব গল্প পড়তে পড়তে এক তীব্র নস্টালজিক বোধে আক্রান্ত হবেন, নিমজ্জিত হবেন স্মৃতিময়তায়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
যতদূর জানি, পিন্টুর সৃজনের ও গবেষণার মূল ক্ষেত্র হল চলচ্চিত্র। তাই এসব গল্পের বুননে নানারকমের সিনেম্যাটিক কাজ দেখে খুব বেশি অবাক হই নি, তবে মুগ্ধ হয়েছি। হয়তো গল্পগুলো লেখার সময় পিন্টুর চেতনায় বা অবচেতনে এগুলোর চলচ্চিত্ররূপ খেলা করেছে, আর সে–কারণেই হয়তো এগুলোতে চিত্রনাট্যসুলভ একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, যা পাঠকের ভালোই লাগবে বলে মনে হয়। বাংলা ছোটগল্পে নিঃসন্দেহে এ–এক নতুন লিখনশৈলী।
বইটির মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ এঁকেছেন চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আনোয়ার হোসেন পিন্টু নিজেই। চমৎকার বাঁধাইয়ের ১২৪ পৃষ্ঠার বইটি মুদ্রিত হয়েছে চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী সিগনেট প্রেসে এবং মূল্য রাখা হয়েছে তিনশ টাকা (দশ ডলার)। ভালো সুপাঠ্য গল্পের এই আকালের সময়ে পিন্টুর গল্পগ্রন্থটির বিপুল প্রচার–প্রসার কামনা করি।